বড়পীর হজরত গাউছুল আজম আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) যিনি ইসলাম ধর্মের প্রচারক, সুফিসাধক, কাদেরিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা ও ‘ মহিউদ্দিন’ নামে খ্যাত যার অর্থ ইসলামের পুনরুজ্জীবিতকারী। ইরাকের জিলান নগরের অধিবাসী এই আউলিয়া সারা পৃথিবীর জুড়ে, যাঁকে নিয়ে রয়েছে অনেক কিংবদন্তি। পিতা ও মাতা উভয়ের দিক থেকে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধর, যিনি মাতৃগর্ভজাত অলি হিসেবে খ্যাত। তাঁর সত্যবাদিতা, মানুষকে উপদেশ প্রদানের আন্তরিকতা, মানুষকে খাওয়ানো, সৃষ্টির প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর কেরামত ভুবন বিখ্যাত। হজরত গাউছে পাক (রহ.) পবিত্র মাজার শরীফ বাগদাদে অবস্থিত হওয়ায় সূফী জগতের বেলায়তের রাজধানী বাগদাদ তাঁর আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। অলিকূলের সম্রাট হজরত গাউছুল আজম আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এর পুরো জীবনই সাধনা ও কারামতে পরিপূর্ণ। সেরকম একটি আশ্চর্যজনক কারামত আমার পিতা শেখ আবুল কাশেমের সাথে ঘটে যায় ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৫ সালে! বলছি সেদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাটির কথা। বাংলাদেশ বিমান নং ৭০৭। বিমানটি দুবাই থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বিমানে ছিল আমার আব্বাসহ মোট ৩০ জন যাত্রী। হঠাৎ মাঝপথে বিমানটির যান্ত্রিকত্রুটি দেখা দেয়। দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কায় সকলেই তখন উদ্বিগ্ন। সকলেই পড়ছে দোয়া দরুদ। যার যার সৃষ্টিকর্তাকে করছে স্মরণ। যে কোন মুহূর্তে ক্রাশ হতে পারে বিমান। যাত্রীদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে বিমানের ভেতর। ঠিক এমন সময় বিমানের পাইলট সিদ্ধান্ত নেন এবং সকল যাত্রীকে জানিয়ে দেন, “বিমান দুর্ঘটনার সম্মুখীন না হলে উনি সকল যাত্রীকে নিয়ে ইরাকের বাগদাদে বড়পীর হযরত গাউছুল আজম আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) মাজার জিয়ারত করবেন এবং সকলকে সেটি নিয়ত করার অনুরোধ করেন।” পাইলটের কথায় আশ্বস্ত হলেন সকলে। পাইলটের এ কথায়, হয়তো সকলে নিয়তও করলেন। পাইলটের যে কথা সেই কাজ। আশ্চর্যজনকভাবে পাইলট কিছুক্ষণ পর জানালেন যান্ত্রিক ত্রুটি মুক্ত বিমান। খুশির হাওয়া বয়ে গেল সকল যাত্রীর ভেতর। পরে সকলে মিলে জিয়ারত করলেন গাউসে পাকের পবিত্র মাজার শরীফ। এই যাত্রায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রহমতে তাঁর মকবুল বান্দা বড়পীরের মাজার জিয়ারতের উছিলায় বিমানটি বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেল। সে সময় আব্বা আরও জিয়ারত করেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.), হযরত ইউসুফ হামদানী (রহ.), ও শেখ আবু সৈয়দ তাবরিজী (র.) এর পবিত্র মাজার শরীফ। আব্বা ঘটনাটি আমাদের বারবার বলতেন এবং তাঁর ডায়েরিতেও এই ঘটনাটি লিখে রেখেছেন।
এখানে আরো একটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো যেই তারিখ আব্বা বড়পীর (রহ.) মাজার জিয়ারত করেন সেই ২০ ফেব্রুয়ারি আব্বা মারা যান, সাল ২০১৭। আব্বা সুফিবাদে বিশ্বাসী একজন মানুষ ছিলেন এবং সেই আদর্শে সারা জীবন চলবার চেষ্টা করেছেন। উনি সবসময় আমাদের সাথে অলি আউলিয়াদের গল্প করতেন। আব্বা বেশ কয়েকবার খাজা গরীবে নেওয়াজ মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) দরবারেও যান। এছাড়া মাইজভান্ডারসহ চট্টগ্রামের অনেক অলি আউলিয়ার পবিত্র মাজার শরীফ আছেন প্রায় সবগুলো তিনি জিয়ারত করেছেন। সবসময় মুখে শোনা যেত পবিত্র কাসিদায়ে গাউছিয়া শরীফ–
“আচ্ছালাম আয় নুরে চশমে আম্বিয়া
আচ্ছালাম আয় বাদশাহে আউলিয়া ”।
সবসময় গাউছুল আজম হজরত আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারি (ক.) কে স্মরণ করতেন। উনার মুর্শিদ দরবারে কামালিয়া শরীফের কুতুবুল আকতাব হযরত শাহসুফি আলহাজ্ব মওলানা ছৈয়দ কামাল শাহ (রা.) এর প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ছিল অগাধ। মুর্শিদের প্রতি ভালোবাসায় উনার আবেগ দেখে আমরা অবাক হতাম। পীরের প্রতি শিষ্যের ভক্তি, শ্রদ্ধা কেমন হতে হয় তা উনাকে দেখে বুঝা যেত। হজরত শাহসুফি হাজী সৈয়দ মোহাম্মদ মিঞা ফরহাদাবাদী (র.)ও আব্বাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনিও ছিলেন একজন আল্লাহর এক মহান আউলিয়া। আউলিয়াদের সংস্পর্শে থাকলে সে মানুষ কখনো অন্যের ক্ষতি করতে পারে না। ধনী, গরীব কোন ভেদাভেদ না করে সবার সাথে হাসিমুখে কীভাবে কথা বলতে হয় আব্বার ব্যবহারে তা বুঝা যেত। গাউছে পাকসহ আউলিয়া কেরামগণ আমাদের শিখিয়ে গেছেন সরলতা, বিনয়, ভদ্রতা,মানুষের প্রতি ভালোবাসায় পারে প্রকৃত মানুষ হতে। তাঁদের শেখানো পথই হোক আমাদের চলার পথের পাথেয়।
লেখক: প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ।