কক্সবাজারের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নির্ভর করছে পর্যটন, নিরাপত্তা, পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো– এই পাঁচটি স্তম্ভের উপর। গতকাল শনিবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ‘কক্সবাজারের উন্নয়ন যাত্রার জোয়ার ভাটা : সমস্যা, সম্ভাবনা ও বৈশ্বিক প্রেক্ষিত’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এমন মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকায় বসবাস করা কক্সবাজারের অধিবাসীদের সংগঠন ‘কক্সবাজার কমিউনিটি অ্যালায়েন্স’ এই বৈঠকের আয়োজন করে। খবর বিডিনিউজের।
বক্তারা বলেন, কক্সবাজার এখন শুধু বাংলাদেশের একটি পর্যটন শহর নয়, এটি হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক ব্যবসা, নীল অর্থনীতি ও আঞ্চলিক সংযোগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। অর্থনীতি, পরিবেশ ও নিরাপত্তা– এই তিন ধারা একসঙ্গে বিবেচনায় এনে মানুষকেন্দ্রিক ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বৈঠকে আয়োজক সংগঠনের করা সাম্প্রতিক একটি জরিপের তথ্য তুলে ধরে দাবি করা হয়, ৮৬ শতাংশ নাগরিক পর্যটনকে কক্সবাজারের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি মনে করেন। ৮৪ শতাংশ মানুষ রোহিঙ্গা সংকটকে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন আর ৯২ শতাংশ চান চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক দ্রুত ছয় লেনে উন্নীত হোক।
বৈঠকে কক্সবাজারের মহেশখালী–কুতুবদিয়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, রাষ্ট্রকে দেওয়ার মত কঙবাজারের অনেক কিছু আছে। অসীম প্রাকৃতিক সম্পদ, সমুদ্র অর্থনীতি ও সম্ভাবনাময় মানুষ। এই উন্নয়নকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে এনে জনগণ ও স্থানীয় নেতৃত্বের অংশগ্রহণে বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং কঙবাজারের খনিজ সম্পদে গবেষণার ওপর গুরুত্ব দেন।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও কঙবাজার–রামু আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার সহিদুজ্জামান বলেন, কঙবাজারের টেকসই উন্নয়নে রাজনৈতিক ঐক্য ও দূরদর্শী নেতৃত্ব অপরিহার্য। পর্যটন নিরাপত্তা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও মৎস্য সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সময়ের দাবি।
কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিশুদ্ধ পানি ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এখন কঙবাজারের বড় সংকট। স্থানীয়দের সম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো প্রকল্প টেকসই হবে না। বুয়েটের অধ্যাপক ফখরুল ইসলাম মনে করেন, সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কঙবাজারকে তাইওয়ানের আদলে একটি প্রযুক্তি–বান্ধব নগরিতে রূপান্তর করা সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আশফাক হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা সংকট শুধু মানবিক নয়, এটি ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও ন্যায়ভিত্তিক নীতি ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।
সাবেক সচিব মাফরুহা সুলতানা বলেন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে কঙবাজারকে কার্যকর উন্নয়ন মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ডাকসুর মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক ফাতিমা তাসনিম জুমা বলেন, কঙবাজারের উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ ও তরুণ নেতৃত্বের কণ্ঠস্বর শোনা জরুরি। মাদক দমনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
এনসিপির সাংগঠনিক সমন্বয়ক এম এম সুজা উদ্দিন বলেন, কঙবাজারের অর্থনীতি মানে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি। এই উন্নয়নের জন্য তরুণদের সম্পৃক্ততা ও রাজনৈতিক আস্থা তৈরি এখন সময়ের দাবি। এবি পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কাসেম বলেন, কঙবাজার এখন জাতীয় অর্থনীতির ফ্রন্টলাইন জোন। প্রশাসনিক সমন্বয় ও স্বচ্ছতা ছাড়া উন্নয়ন পরিকল্পনা স্থায়ী হবে না।
আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা কঙবাজারে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও লবণ শিল্পের বিকাশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং সৈকত পরিচ্ছন্নতা ও বালিয়াড়ি পুনরুদ্ধার উদ্যোগকে সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে বৈঠকের আয়োজক সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক মোহিব্বুল মোক্তাদির তানিম বলেন, কঙবাজার বাংলাদেশের উপকূল নয়, এটি দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের কৌশলগত দিগন্ত। মানুষ, প্রকৃতি ও সম্ভাবনাকে একত্র করে দায়িত্বশীল উন্নয়নের ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চাই।