শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে ভয়াবহ আগুন

বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় আটকা পড়েন শত শত যাত্রী ৭ ঘন্টা পর নিয়ন্ত্রণে, ফ্লাইট ওঠানামা শুরু, তদন্ত কমিটি

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ১৯ অক্টোবর, ২০২৫ at ৯:৩৮ পূর্বাহ্ণ

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল শনিবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে ফায়ার সার্ভিসের ৩৬টি ইউনিট। সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ, আনসার, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সদস্যরাও যোগ দেন অগ্নি নির্বাপণের কাজে। এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরে সব ধরনের ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রাখা হয়। বেলা সাড়ে ৩টা থেকে সেখানে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ থাকার তথ্য দেয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ থেকে যেসব ফ্লাইট ঢাকায় নামার কথা, সেগুলোকে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে যেতে বলা হয়। ঢাকায় নামতে না পেরে অন্য বিমানবন্দরে চলে যায় এক ডজনের বেশি ফ্লাইট। ভয়াবহ এ আগুনের পর প্রথমে শাহজালালের এয়ারফিল্ড গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও পরে তা রাত ৯টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। বিমানবন্দরে আটকা পড়েন শত শত যাত্রী।

এদিকে কার্গো কমপ্লেক্সে লাগা আগুন ৭ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছে। গতকাল রাত ৯টা ১৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কথা জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম রনি। রাত ১০টায় ঘটনাস্থলে এসে ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। বাড়ার আর আশঙ্কা নেই। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর রানওয়ে প্রস্তুত হওয়ায় ফ্লাইট চলাচল শুরুর অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। ৬ ঘণ্টা পর বিমান ওঠানামা স্বাভাবিক হয়েছে। ইতিমধ্যে তিনটি ফ্লাইট ছেড়ে যাওয়ার তথ্য দিয়েছেন বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা। বিমানবন্দরে ভিড় করে আছেন বিদেশগামী যাত্রীরা।

আগুনের ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। শাহজালালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ পাঁচ দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলেছে। খবর বিডিনিউজের।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শাহজালালে নামতে না পেরে আটটি ফ্লাইট চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর মধ্যে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের ব্যাংকক থেকে ঢাকা এবং এয়ার অ্যারাবিয়ার শারজাহ থেকে ঢাকার দুটি ফ্লাইট রয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সৈয়দপুর থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইটটি ঢাকায় অবতরণ না করে চট্টগ্রামে অবতরণ করে। একইভাবে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি ফ্লাইট উড্ডয়নের পর পুনরায় চট্টগ্রামে ফিরে যায়। দিল্লি থেকে ঢাকার পথে থাকা ইন্ডিগো ফ্লাইট অবতরণ করে কলকাতায়। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরগামী বাটিক এয়ারের ওডি১৬৩ ফ্লাইট এবং ঢাকা থেকে মুম্বাইগামী ইন্ডিগোর ৬ই১১১৬ ফ্লাইট ট্যাক্সিওয়েতে অপেক্ষা করে। হংকং থেকে ঢাকা আসা ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইনসের বিমানটি অবতরণ না করতে পেরে অন্য বিমানবন্দরে যায়।

পরে রাত ৯টার দিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এক বার্তায় বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ড সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসার খবর দেয়। সেখানে বলা হয়, ফায়ার সার্ভিস ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় করে নিশ্চিত করা যাচ্ছে যে, আগুন সম্পূর্ণ নিভে গেছে। রাত ৯টা থেকে সব ফ্লাইট কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হবে। বিমানবন্দর ব্যবহারকারী যাত্রী ও সাধারণ জনগণের সহযোগিতা ও ধৈর্য ধারনের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

৬ ঘণ্টা পর ফ্লাইট ওঠানামা শুরু : অগ্নিকাণ্ডের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ৬ ঘণ্টা পর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা শুরু হয়েছে। গতকাল রাত ৯টা ৬ মিনিটে প্রথম ফ্লাইট ছেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ।

এদিকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এক বার্তায় বলেছে, শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়ে ৯টায় থেকে চালু হওয়ায় দ্রুততম সময়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ডাইভার্ট হয়ে আসা ফ্লাইটগুলো ঢাকা ফিরে যাবে।

তদন্ত কমিটি : আগুনের ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। শাহজালালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ পাঁচ দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলেছে। গতকাল রাত ৯টার পরে বিমানের এক অফিস আদেশে এয়ারলাইনটির ফ্লাইট সেফটি বিভাগের পরিচালককে সভাপতি করে এ কমিটি করা হয়।

কমিটিতে রাখা হয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের একজন প্রতিনিধি, বিমানের করপোরেট সেফটি অ্যান্ড কোয়ালিটি বিভাগের জিএম, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ার, নিরাপত্তা বিভাগের ডিজিএম, কার্গো রপ্তানি বিভাগের ডিজিএম এবং ইন্স্যুরেন্স বিভাগের একজন ডিজিএমকে।

কমিটিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ চিহ্নিতকরণ, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, অগ্নিকাণ্ডের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সুপারিশমালা তৈরি করতে বলা হয়েছে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার হিসেবে আমদানিরপ্তানির মালামাল উড়োজাহাজে ওঠানামাসহ কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ে যাবতীয় দায়িত্ব বিমান বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের। এ দায়িত্বের অংশ হিসেবে আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে আগুনের ঘটনায় সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে বিমান।

আগুন লাগে কুরিয়ার গুদাম থেকে : শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের যে অংশে কুরিয়ারের কাজকর্ম চলে, সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার কথা বলছেন কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা। অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠুর ভাষ্য, গতকাল সরকারি ছুটির দিনে দুপুর ২টা পর্যন্ত কার্গো ভিলেজের নিয়মিত কাজকর্ম চলে। সেখানে তখনো অনেক শ্রমিক ও আনসারসহ লোকজন ছিলেন। কিন্তু আগুন লাগার পর আনসারসহ অন্যরা সবাইকে সরিয়ে দেন। তখন বলা হয়, এই গুদামে গোলাবারুদসহ রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে; বিস্ফোরণ ঘটতে পারে; সবাই সরে যান।

শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিনে কার্গো ভিলেজের নিয়মিত কাজকর্ম বন্ধ থাকলেও কুরিয়ার শাখায় আধাবেলা কাজকর্ম চলে। এ কারণে এক শিফটের কর্মীরা আগেই বের হয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী শিফটে যাদের আসার কথা ছিল, তাদের অনেকে তখনও ঢোকেননি। আবার সারা দিনের শিফটে যাদের কাজ করার কথা ছিল, তাদের তখন দুপুরের খাবারের বিরতি চলছিল। এ কারণে আগুন লাগার সময় সেখানে এয়ারলাইন্স ও এজেন্টদের কর্মী কম ছিল।

মিঠু বলেন, কুরিয়ার গুদামের এক পাশে রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। দেশের পোশাক খাতসহ বিভিন্ন শিল্পের জন্য আনা অনেক রাসায়নিক আকাশপথে আমদানি করা হয়। তিনি দাবি করেন, আগুন নেভাতে এসে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ৮ নম্বর ফটকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অনুমতিজনিত জটিলতায় তারা ঢুকতে পারছিলেন না।

কার্গো ভিলেজ লম্বায় আনুমানিক ৩০০ মিটার। বিমানবন্দরের উত্তরপূর্ব কোনায় এর অবস্থান। বিমানের কার্গো শাখার তিনজন কর্মী দাঁড়িয়েছিলেন। তারা বলছেন, কুরিয়ার শাখা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর তারা দৌড়ে বেরিয়ে আসেন। আমদানির কার্গো কমপ্লেক্সের সামনে উড়োজাহাজ পার্কিং করার ১০ থেকে ১৪ নম্বর বে। আগুন লাগার পর এখানে রাখা কয়েকটি উড়োজাহাজ সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বিমানের কর্মীরা।

কুরিয়ার সেকশনে থাকা বিমানের কর্মীরা বলছেন, কুরিয়ার সেকশনের সেডের বাইরেও অনেক মালামাল উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে রাখা হয়েছিল; সেগুলোও পুড়ে গেছে।

মন্ত্রণালয়ফায়ার সার্ভিসের তথ্যে ফারাক : কার্গো ভিলেজে কখন আগুন লেগেছে তা নিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্যে ১৫ মিনিটের ফারাক রয়েছে। আর কার্গো কমপ্লেক্সের আমদানি পণ্যের যে অংশে আগুন লেগেছে সেখানে আমদানিরপ্তানি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্টরা আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট কাজে আসতে দেরি হওয়ায় ক্ষোভ ঝেড়েছেন। তাদের অভিযোগ, আগুন লাগার অনেকক্ষণ পরে সেখানে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিটটি কাজ করতে এসেছে। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের গাড়িকে আট নম্বর ফটকে নিরাপত্তাজনিত কারণে কিছুক্ষণ আটকে রাখা হয়েছিল বলেও অভিযোগ তাদের।

আগুন লাগার সময়ের বিষয়ে বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগুন লেগেছে দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে। অপরদিকে ফায়ার সার্ভিস বলছে, তারা আগুন লাগার খবর পেয়েছে ২টা ৩০ মিনিটে। তাদের প্রথম ইউনিটটি ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে ২টা ৫০ মিনিটে। এ হিসাবে আগুন লাগার অন্তত ৩৫ মিনিট পর ফায়ার সার্ভিসের প্রথম গাড়িটি সেখানে পৌঁছেছিল। এ রকম একটা স্পর্শকাতর স্থানে আগুন লাগার ৩৫ মিনিট পর কেন ফায়ার সার্ভিস পৌঁছাল সেই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর মিলছে না।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল বাতাস : বাংলানিউজ জানায়, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল জানিয়েছেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল বাতাস। গতকাল রাত ১০টায় বিমানবন্দরের আট নম্বর গেটের সামনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। আগুন নেভাতে দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আসলে আগুন নেভাতে এসে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বাতাস। যেহেতু এটা খোলা জায়গা, প্রচুর বাতাস ছিল। ফলে অক্সিজেনের প্রাপ্তি সবসময় ছিল, যেটা আগুন জ্বালাতে সহায়তা করে। যে কারণে আপনারা অনেক ওপর পর্যন্ত ধোঁয়া দেখতে পেয়েছেন।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের হিসাবে আমাদের দুজন ফায়ার ফাইটার আহত হয়েছেন। আমরা শুনেছি, আনসারের কিছু সদস্য সম্ভবত প্রাথমিকভাবে আহত হয়ে থাকতে পারেন, আমরা সংখ্যাটা এখনও কনফার্ম না। আগুনের সূত্রপাত কিভাবে হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন আমরা এটা বলতে পারছি না। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা একদিকে আগুন নিভিয়েছি, আরেক দিকে আমরা জায়গা করে দিয়েছি জিনিসপত্র বের করে নিয়ে আসার জন্য। তো অনেক জিনিসপত্র আমরা দেখেছি বের করতে। এখন কি পরিমাণ, কতটুকু, এটা আসলে এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না। কিন্তু কিছু কিছু জিনিসপত্র বের হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুড়েছে আমদানির অংশ, নিরাপদ রয়েছে রপ্তানির অংশ : বিমান উপদেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬