Echolalia (বাংলায় কোন শব্দার্থ পাইনি) অর্থ হল অন্যের কথা বলা বা শব্দ পুনরাবৃত্তি করা যা একটি স্বয়ংক্রিয় ও অনৈচ্ছিক আচরণ। এটি শিশুদের ভাষা বিকাশের একটি স্বাভাবিক অংশ যা ৩ বৎসরের পর চলে যায়। এ ইকোলালিয়ার আচরণটি অব্যাহত থাকলে তা অটিজম বা অন্যান্য বিকাশজনিত অক্ষমতার লক্ষণ হতে পারে। প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি ডিমেনশিয়া বা স্ট্রোকের মত স্নায়ুবিক কারণে ঘটতে পারে। ইকোলালিয়ার প্রকার ভেদ:
১। তাৎক্ষনিক ইকোলালিয়া(Immediate Echolalia): এক্ষেত্রে শিশু যা শুনে সাথে সাথে তা পুনরাবৃত্তি করে, যেমন–মা বলল “এখন খাবারের সময়” তখন সাথে সাথে শিশুটি বলে উঠে “এখন খাবারের সময়”।
২। বিলম্বিত ইকোলালিয়া (Delayed Echolalia): এক্ষেত্রে শিশু কারও কথা বা শব্দ কয়েক ঘণ্টা এমনকি পরের দিনও সেই কথা বা বাক্য পুনরাবৃত্তি করতে পারে। যেমন– সকালে স্কুলের টিচার বলেছিল “তুমি ভাল ছেলে” শিশুটি রাত্রে এসে মা কোন কাজে প্রশংসা করলে সেও বলে উঠে “তুমি ভাল ছেলে”।
ইকোলালিয়া শব্দটি গ্রীক মূল “ইকো” এবং “লালিয়া” থেকে এসেছে, যেখানে “ইকো” অর্থ “পুনরাবৃত্তি” আর “লালিয়া” শব্দের অর্থ “বক্তৃতা”। অনেক সময় অটিস্টিক শিশুরা অন্যের সম্পূর্ণ বাক্য না নিয়ে কোন একটি শব্দ নিজেদের করে উচ্চারণ করে। এতে সে ব্যাকরণ বদলিয়ে ফেলে। যেমন– টিচার বলল “বইটি টেবিলে আছে” আর সে বলল “টেবিলে বই”। মা মুখ বড় করে খুলতে বললে আর সে বলল “বড় হা” এটাকে Mitigated ইকোলালিয়া বলে। অনেক সময় শিশুরা কোন ব্যস্ত এলাকা বা জনসভা থেকে মাইকে কারও বক্তব্য শুনে পরে তা বলতে থাকে। যেমন– জনসভায় সে নেতাকে বলতে শুনছে “ভাইসব আমি বলতে চাই”। এ কাজটি সে বাসায় এসে বার বার বলতে থাকে। এটাকে Ambient ইকোলালিয়া বলা হয়। অনেক শিশু হঠাৎ একটি বাক্য বার বার বলতে থাকে, যেমন– “খেলার মাঠে” সে বলতে থাকে “কে কে খেলতে চাও” এটি কোন প্রশিক্ষক ছাত্র–ছাত্রীদের বলতে বললে সেও একই বাক্য বলতে থাকে। এটাকে Echoing Approval বলা হয়। কিছু কিছু অটিস্টিক শিশুও কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ইকোলালিয়া করে থাকে। বিশেষ কোন আনন্দে বা দিনে সে বলতে পারে “চল গান করি” যখন কোন গানের কলি সে আলতোভাবে কারও কাছ থেকে শুনে। এটাকে ওInteractive Echolalia বলা হয়। অনেক অটিস্টিক শিশু আছে ভয়ের সময় সম্পূর্ণ ভিন্ন বাক্য দিয়ে তার ভাব প্রকাশ করে। যেমন– শিশু ভয় পেলে বলতে থাকে “তুমি কি ভাল ডাইনী না খারাপ ডাইনী”। এটা হয়তো কাউকে মন্দ বলার জন্য উচ্চারণ করেছে।
কারণ সমূহ: ইকোলালিয়া অনেক অটিস্টিক শিশুর বৈশিষ্টগতভাবে বর্ণিত। ASD আক্রান্ত প্রায় ৭৫ ভাগ শিশুদের ইকোলালিয়া দেখা যায়। ১৯৪৩ সালে ক্যানার দ্বারা অটিজম আক্রান্ত ১১ জন শিশুর মধ্যে এটি বর্ণনা করা হয়েছিল। এছাড়া এফাসিয়া, অটোইমিউন ব্যাধি, মাথায় আঘাত, জন্মগতভাবে অন্ধত্ব, এনসেফালাইটিস, বুদ্ধির অক্ষমতা, ভাষা বিলম্ব, সিজোফ্রেনিয়া, স্ট্রোক এবং মৃগীরোগের পরবর্তী পর্যায়ে দেখা দিতে পারে।
কেন হয়: ঐতিহাসিকভাবে ইকোলালিয়া একটি অর্থহীন “বক্তৃতা ব্যাধি” হিসাবে বর্ণনা করা হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গিয়েছে যে ইকোলালিয়ার একটি যোগাযোগমূলক কার্যকারিতা থাকতে পারে। অটিস্টিক শিশু ইকোলালিয়া কেন করে তার কারণ হচ্ছে– ক) সে ভাল করে বুঝতে চেষ্টা করে, খ) কাউকে অনুরোধ করলে, গ) যোগাযোগের মাধ্যম, ঘ) যখন টেনশনে থাকে, ঙ) মনের অনুভূতি দমিয়ে রাখতে, চ) সবশেষে কাউকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। ইকোলালিয়া কেবল মাত্র তোতা পাখির বুলি নয় এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। ইকোলালিয়া অটিস্টিক শিশুর মন ও মানসিকতাকে উজ্জীবিত করে। এটা অনেকটা হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রীর মন্ত্র পড়ার মত।
ইকোলালিয়ার জটিলতা: ইকোলালিয়া সামাজিকতা ও শেখার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে একাধিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন– উদ্বেগ ও বিষন্নতা ও স্কুলে খারাপ ফলাফল, সহকর্মীদের দ্বারা নির্যাতন, স্কুলে অনুপস্থিতি, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সবশেষে ধমক ও অগ্রহণযোগ্যতার কারণে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।
ইকোলালিয়ার উপকারিতা: পূর্বে এটাকে নেতিবাচক, অর্থহীন, স্টেরিওটাইপিক আচরন হিসাবে বিবেচনা করলেও সামগ্রিক গবেষণায় দেখা যায় যে, ইকোলালিয়া হল রোগীদের ভাষা শেখার অসুবিধার প্রতি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া। এটি ভবিষ্যতের ভাষা বৃদ্ধির জন্য একটি ইতিবাচক ভবিষ্যৎবাণী হিসাবে বিবেচিত করা যেতে পারে।
চিকিৎসা বা ব্যবস্থাপনা: কথা বলার সময় ছোট ছোট শব্দ ব্যবহৃত করা, তরিৎ উত্তর দেয়া, একজন পার্টনারের সাথে মডেলিং করা, নাম ধরে না ডাকা, কোন প্রশ্ন না করা, সংকেত বিরাম বিন্দু প্রশিক্ষণ, ভিজুয়েল ইঙ্গিত। ইকোলালিয়া মূল্যায়ন এবং চিকিৎসায় সঙ্গীত থেরাপিও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বড়দের ক্ষেত্রে বিশেষ করে স্ট্রোক রোগীর ক্ষেত্রে ঔষধ দেয়া যেতে পারে। SSRI ঔষধটি দেয়া যেতে পারে।
পরামর্শ: নিম্ন বর্ণিত পরামর্শের প্রয়োজন–
চাইল্ড নিউরোলজিস্ট,
স্পীচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ রোগ বিশেষজ্ঞ,
থেরাপিস্ট,
মনোবিজ্ঞানী ও
বিশেষ প্রশিক্ষক এর সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।
পিতা–মাতার প্রতি পরামর্শ: অটিজম বা অন্যান্য স্নায়ুবিদ রোগের সাথে সম্পর্কিত ইকোলালিয়া পরিচালনায় মা–বাবার অংশগ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মা–বাবাকে অবশ্যই প্রাক–প্রোগ্রামগুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। তাই হতাশ না হয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিবেন। এর মাধ্যমে ইকোলালিয়ার সমস্যা সমাধান হতে পারে।
লেখক : পরিচালক, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল।