চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তামান্না মাহবুব। সদ্য অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে সহক্রীড়া সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছেন তিনি। এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ১৪ জন প্রার্থী, আর তাঁদের মধ্যে একমাত্র নারী প্রতিনিধি ছিলেন তামান্না। তিনি ৪,৯২৯ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তামান্না মাহবুব বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য। গত বছর আগস্টে তিনি সংগঠনটিতে যুক্ত হন। এবারের নির্বাচনে তিনি ছাত্র ফেডারেশন ও স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি সমর্থিত প্যানেলের ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ থেকে প্রার্থী ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬টি পদের মধ্যে ২৪টিতে জয় পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির, একটি পদে জয় পেয়েছে ছাত্রদল। এ দুই সংগঠনের বাইরে একমাত্র বিজয়ী প্রতিনিধি হচ্ছেন তামান্না মাহবুব। দৌড়, চাকতি, লম্বা জাম্প, ম্যারাথন, ভলিবলসহ নানা ক্রীড়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে নির্বাচনের শুরু থেকেই তিনি আলোচনায় ছিলেন।
খেলাধুলা থেকে নেতৃত্বে : তামান্নার খেলাধুলার যাত্রা শুরু কলেজজীবনে। ছোটবেলা থেকেই মাঠে তাঁর পদচারণা দৌড়, চাকতি নিক্ষেপ, লম্বা জাম্প, সব জায়গাতেই ছিলেন পারদর্শী। ২০১৭ সালে কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ৮০০ ও ৪০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হন; পরের বছরও জেতেন ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নের খেতাব।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেও সেই সাফল্যের ধারা বজায় রেখেছেন। অংশ নিয়েছেন ইন্টার ইউনিভার্সিটি হ্যান্ডবল টুর্নামেন্ট, আন্তঃজেলা ভলিবল প্রতিযোগিতা ও জাতীয় নারী ভলিবল টুর্নামেন্টে। নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন ম্যারাথন ও লম্বা দূরত্বের দৌড় প্রতিযোগিতায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বর্তমানে ‘দ্রুততম মানবী’ খেতাবের অধিকারী। সামপ্রতিক বছরগুলোতে হল ও কেন্দ্রীয় প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিকভাবে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনি।
‘আমি চাই মেয়েরা নিজেদের সক্ষমতা বুঝুক’: ১১ বছরের খেলাধুলার অভিজ্ঞতা নিয়ে এখন চাকসুর সহক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে নতুন মঞ্চে নামছেন তামান্না মাহবুব। তিনি বলেন, ‘খেলাধুলা শুধু আমার নেশা নয়, এটা আমার আত্মার একটা অংশ। আমি জানি মাঠে মেয়েদের কী কী বাধা আসে। সহক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে আমি চাই মেয়েদের অংশগ্রহণ আরও বাড়ুক, তারা যেন নিজেদের সক্ষমতা বুঝতে পারে।’;
তবে শুধু মেয়েদের জন্য নয় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া সংস্কৃতির উন্নয়নই তাঁর লক্ষ্য। ‘খেলাধুলা মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মবিশ্বাস গঠনের শক্তিশালী মাধ্যম। আমি চাই, ক্যাম্পাসে এমন পরিবেশ তৈরি হোক যেখানে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই অংশ নিতে উৎসাহিত হয়,’ বলেন তিনি।
‘আমাকে প্রমাণ করতে হবে মেয়েরাও পারে’: তামান্না জানেন, তাঁর অবস্থানটা প্রতীকীও বটে। সহক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর একটাই লক্ষ্য, ছাত্রীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগানো। ‘ভবিষ্যতে আবার নির্বাচন হবে। ছাত্রীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য হলেও আমার সবচেয়ে ভালো কাজ করতে হবে। মানুষজনকেও বিশ্বাস করাতে হবে যে একজন ছাত্রী পদে এলেও সে পারবে। যাতে সবাইকে বোঝানো যায়, আপনি চাইলেই ছাত্রীদের বিশ্বাস করতে পারেন,’ বলেন তিনি দৃঢ় কণ্ঠে।
কৃতজ্ঞতা আর প্রত্যয়ের মিশেল : নিজের সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিও গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তামান্না মাহবুব। খেলাধুলা ও একাডেমিক ব্যস্ততার কারণে সংগঠনকে পুরোপুরি সময় দিতে না পারলেও, তাদের সহায়তা পেয়েছেন সবখানে। ‘নির্বাচনের খরচ থেকে শুরু করে প্রচারণা পর্যন্ত, সব জায়গায় সংগঠনের সবাই পাশে থেকেছে,’ বলেন তিনি।
তামান্নার ভাষায়, তাঁর এই জয় কেবল ব্যক্তিগত নয় এটা সেই সব মেয়েদের জয়, যারা নেতৃত্বে আসতে এখনো দ্বিধায় ভোগেন। ‘আমার এই জয় কেবল নিজের নয়, বরং সেই মেয়েদের জয়, যাঁরা এখনো নেতৃত্বে আসতে দ্বিধাবোধ করেন। আমি চাই, আমার কাজ দেখে মেয়েরা সাহস পাক। সবাই যেন বিশ্বাস করে, সুযোগ দিলে ছাত্রীরাও পারে। আমি এটি দেখিয়ে দিতে চাই।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু নির্বাচনে সহক্রীড়া সম্পাদক পদে তামান্না মাহবুবের এই জয় শুধু একটি পদ জয় নয় এটি নারী অংশগ্রহণ, সাহস এবং সম্ভাবনার প্রতীক। তিনি প্রমাণ করতে শুরু করেছেন, নেতৃত্বের মঞ্চে মেয়েরা যেমন উঠে আসতে পারে, তেমনি পারে পুরো প্রেক্ষাপট বদলে দিতে।