এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ‘ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড’ স্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে বেশ প্রকট। এই অসুখে আক্রান্ত রোগীর প্রায় ৬৮ শতাংশ হলো শিশু। সাম্প্রতিক সূত্রমতে টাইফয়েড রোগে ভুগে দেশে প্রতিবছর ৮০০০ প্রাণ অকালে ঝরে যায়। দেশে ইপিআই বিনামূল্যে মাসব্যাপী ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কমবয়সী ৫ কোটি শিশুকে টাইফয়েড রোগ প্রতিষেধক টিকাদান কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
শিশুর টাইফয়েড রোগ
‘শিশুর টাইফয়েড জ্বর’ মারাত্মক হতে পারে। এর জীবাণু– ‘সালমোনিলা টাইফি’। যেখানে স্যানিটারী ব্যবস্থাপনা দুর্বল, সেখানে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। সংক্রমিত রোগীর মল–মূত্র, কফ, বমি ইত্যাদির মাধ্যমে টাইফয়েডের জীবাণু, শিশুর খাদ্যদ্রব্য, পানীয় জল কিংবা অপাস্তুকৃত দুধে মিশে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ–প্রত্যঙ্গে সংক্রমণ ঘটায়।
রোগের উপসর্গ–
* জীবাণু শরীরে প্রবেশের ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়। উপসর্গ দেখা দেওয়ার পূর্বে ১০ থেকে ২০ শতাংশ শিশু ক্ষণস্থায়ী ডায়রিয়ায় ভোগে। পরবর্তীতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, ক্ষিদে লোপ, শুষ্ক কাশ, মাথার সম্মুখভাগে ব্যথা ইত্যাদি দেখা যায়।
* টাইফয়েড অসুখের প্রধান লক্ষণ– জ্বর, জ্ঞান লোপ পাওয়া, পেট ব্যাথা, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং যকৃত–প্লীহা স্ফীতি।
* প্রথম সপ্তাহে ৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ রোগীতে জ্বর থাকে। যা প্রথম দিকে থাকে সাময়িক, পরে একনাগাড়ে স্থায়ী হয়। তাপমাত্রা কখনো কখনো ১০৩ ডিগ্রী থেকে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট (৩৯– ৪০০ সেন্টিগ্রেড) পর্যন্ত ওঠে। এ সময় শিশু কোষ্ঠকাঠিন্যতে ভোগে। কোনো কোনো শিশুর ত্বকে ‘রোজ স্পটস্্’ জাতীয় র্যাশ পরিলক্ষিত হয়।
* দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শিশু খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। পেট ফুলে, বাড়ে শ্বাস ও হৃদস্পন্দন হার। রোগ–জটিলতা থেকে এ সময়ে আন্ত্রিক–নালীতে ফুটো ও আন্ত্রিক রক্তক্ষরণ হতে পারে। যকৃত ও প্লীহার আকার আরও বৃদ্ধি পায়।
ক্লিনিক্যালি রোগ নির্ণয়–
শিশু টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে জ্বরের সাথে নিচের যেকোনো একটি থাকে–
ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠবদ্ধতা, বমি, পেটব্যথা, শিরঃপীড়া, বিশেষত জ্বর যদি সাত বা তার বেশি দিনের হয়, এবং শিশু ম্যালেরিয়ার আক্রান্ত নয় তা নিশ্চিত করা গেছে।
ল্যাবরেটরি পরীক্ষা–
রক্তের কালচার হলো রোগ নির্ণয়ের প্রধান উপায়। তবে অসুখ শুরুর ৭ দিন পর থেকে সেরোলজি পরীক্ষায় (আইসিটি)রোগ–জীবাণুর উপস্থিতি ধরা পড়ে।
চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা–
* টাইফয়েডে ভোগা শিশু–রোগীর সাধারণ ব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে–জ্বর লাঘবে প্যারাসিটামল, পানি ও তরল খাবার বেশি বেশি খাওয়ানো।
* টাইফয়েডের চিকিৎসায় বর্তমানে অনেক ওষুধ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তিপূর্বক, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা প্রদান করতে হয়।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা–
* শিশুর খাবার পরিবেশনে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। বাসি রাস্তার ধারের খোলা খাবার শিশুকে না খাওয়ানো। দূষিত পানি, ফুচকা, লাচ্ছি, অপরিচ্ছন্নভাবে পরিবেশিত ফলমূল–সালাদ ও সঠিকভাবে ফ্রিজে না রাখা আইসক্রিম শিশু–বয়সে টাইফয়েড হওয়ার প্রধান কারণ। সবসময় পানি ফুটিয়ে শিশুকে পান করানো।
* শিশুর ‘হাত ধোয়া স্বাস্থ্যবিধি’ পালন। সংক্রমিত ব্যক্তির বর্জ্য পদার্থের সংস্পর্শ থেকে শিশুর খাবার নিরাপদ রাখা।
টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি)
* সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পরিচালিত স্কুলসমূহে প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থীদের জন্য চালু হয়েছে ‘বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যসেবা’। এই অনন্য কর্মসূচিতে ‘স্কুল শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যকার্ডে’ টাইফয়েড টিকাদানের উল্লেখ আছে। কাজেই প্রাক্–প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল পড়ুয়া সকল শিশুর অভিভাবকদের উচিত– আপন শিশুকে এই টাইফয়েড টিকাদানের সুযোগ গ্রহণ করা।
* টাইফয়েড রোগ প্রতিষেধক টিকা অনেক বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা কার্যকর, বিশেষত: ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড রোগ বিস্তারে এই টিকা গুরুত্বপুর্ণ। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সামান্য, যেমন– সুঁচ প্রয়োগের স্থানে ব্যথা–বেদনা, অস্বস্তি, ১৫–৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে জ্বর, পেটে অস্বস্তি, বমিভাব ও বমি ইত্যাদি।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।