চট্টগ্রামবাসীর প্রিয় পত্রিকা, এককথায় চাটগাঁর মুখপত্র, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সগৌরবে ৬৬ বছরে পদার্পণ করলো। এটি আজাদী পত্রিকার জন্য যেমন গৌরবের, তেমনি চট্টগ্রামের বৃহৎ পাঠক সমাজের জন্যও ভালোলাগা এবং আনন্দের বিষয়।
১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আজাদী পত্রিকার পথচলা শুরু। দীর্ঘ এই ৬৬ বছর নানা সংকট, বাধাবিপত্তি এবং হাজারো প্রতিকুলতাকে ডিঙিয়ে আজাদী দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। গঠনমূলক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন ছিল আজাদীর মূল লক্ষ্য ও আদর্শ। চলার পথে অকপটে সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছে আজাদী। সকল ঝড়–ঝঞ্ঝা ও বঞ্চনাকে তুচ্ছ করে সাহসিকতায় আজাদী ছিল অবিচল ও আপসহীন।
আমি ১৯৮৭ সালে নগরীর একটি প্রাইভেট কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে চট্টগ্রাম পৌর কর্পোরেশনে জনসংযোগ কাম প্রটোকল অফিসার পদে চাকুরিতে যোগদান করি। চট্টগ্রাম পৌর কর্পোরেশনে আমিই প্রথম এই পদে কাজ শুরু করি। আমার চাকরির প্রধান কাজ ছিল প্রতিদিন পৌর কর্পোরেশনের (পরবর্তীতে সিটি কর্পোরেশন) অথবা প্রশাসক/ মেয়রের নানা কর্মকাণ্ডের নিউজ করা এবং তা প্রকাশের জন্য গণমাধ্যমে পাঠানো। তখন কম্পিউটার বাজারে আসেনি।
বাংলা টাইপ মেশিনে স্টেনোগ্রাফার বা টাইপিস্ট প্রতি কাগজের উপর কার্বন দিয়ে নিউজ টাইপ করতেন। নিউজে কিছু যোগ করতে হলে বা সংশোধন করতে হলে পুনরায় টাইপ করতে হতো কিংবা ঐ নিউজের কাগজে হাতে ছোটাকারে লিখে দিতে হতো। এভাবে ৫ কপি করে দুইবার ১০ কপি টাইপ করতে হতো। প্রথম কপিটাই দৈনিক আজাদীতে পাঠাতাম, যাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, পড়তে সমস্যা না হয়। পাঠানোর পর নিউজটা ছাপানোর জন্য কয়েকটি পত্রিকার মধ্যে আজাদী অফিসে অবশ্যই ফোন করে অনুরোধ জানাতাম। টিএন্ডটি ফোনে কল দিলে আজাদী থেকে প্রয়াত সিনিয়র সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় ওবায়দুল হকের খুব চমৎকার ভারী কণ্ঠে ভেসে আসতো ‘দৈনিক আজাদী’। এমনি আরো অনেক সিনিয়র সাংবাদিককে ফোন করে পাঠানো নিউজটা ছাপানোর অনুরোধ জানাতাম। তাঁরা সকলেই নিবেদিতভাবে দৈনিক আজাদী তথা চট্টগ্রামের গণমানুষের সংবাদসেবায় কাজ করে গেছেন।
পরের দিন কোন্ কোন্ পত্রিকায় নিউজগুলো ছাপা হলো তা সহকারী পিআরওসহ আমি দেখতাম এবং ছাপার অংশটি কাটিং করে কাগজে পেস্ট করিয়ে সবগুলো প্রশাসক/মেয়রের দপ্তরে পাঠাতাম।
ঢাকার ইত্তেফাক, সংবাদ, ইনকিলাব, আজকের কাগজ, নিউনেশন, অবজারভারসহ প্রায় পত্রিকায় নিউজ ছাপা হলেও প্রশাসক/মেয়র কাটিং দেখার আগেই জিজ্ঞাসা করতেন ‘গতকালিয়ের নিউজ ইয়েঁন আজাদীত্ ছাপ্পিনা? অন্যান্য পত্রিকার চেয়ে আজাদীতে ছাপা হলেই প্রশাসক/ মেয়রের নিউজ ক্ষুধা আশি শতাংশ যেন মিটে যেতো মনে হয়। ঢাকার পত্রিকার উদ্ধৃতি দিলে বলতো ঐ পত্রিকা চট্টগ্রামের কয়জন মানুষ পড়ে। আজাদী হলো চট্টগ্রামের ঘরে বাজারে। তাই চাকরি জীবনে আজাদীতে নিউজ ছাপানোই ছিল আমার দায়িত্বের অন্যতম কাজ। দৈনিক আজাদীর প্রতি সব প্রশাসক/মেয়রের মধ্যে বিশেষ একটা আকর্ষণ বা দুর্বলতা লক্ষ্য করেছি। আমার মতে এটিই আজাদী পত্রিকার সবচেয়ে বড় অর্জন ও কৃতিত্ব।
তৎকালীন সময়ের কৃতীমান পুরুষ, বিরল ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের মেধা, অক্লান্ত সাধনা ও ত্যাগের ফসল আজকের এই দৈনিক আজাদী। তাঁরই পথধরে গুণী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, জনাব এম এ মালেক আজাদীর মাধ্যমে চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও সম্ভাবনা, মেহনতি মানুষের অধিকার, সুখদুঃখের কথা, গণমানুষের চাওয়া–পাওয়া সাহসিকতার সাথে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছেন। এই জন্যই দৈনিক আজাদী চট্টগ্রামে মুখপত্র হয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীর ভালোবাসা, আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে ভোরবেলায় মানুষের দুয়ারে নতুন বার্তার আলো জ্বালায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ছড়াকার; সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন