জাতীয় নির্বাচনের আগে এই স্বল্প সময়ে ‘কোনো রকম ঝুঁকি’ চান না মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রতিরক্ষাবাহিনীর সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক বজায়’ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তার ভাষ্য, বাংলাদেশের সকল অর্গানে যেন ব্যালেন্স থাকে, সেই চেষ্টা করতে হবে আপনাকে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা। আমরা চাই না প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর মধ্যে কোনো রকমের ভারসাম্য নষ্ট হোক। আমরা সেটা এফোর্ট করতে পারব না এই মুহূর্তে।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জরুরি বৈঠকে এ কথা বলেন সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, আমরা চাই, আপনার সাথে প্রতিরক্ষাবাহিনীর সুসম্পর্ক বজায় থাকুক। রাষ্ট্রের একটা ব্যালেন্স থাকতে হবে। আমরা নির্বাচন সামনে রেখে কোনরকমের ঝুঁকির মধ্যে যেতে চাই না। যেতে পারব না। খবর বিডিনিউজের।
প্রধান উপদেষ্টাকে বাস্তবতার নিরিখে পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন বলেন, পতিত স্বৈরাচার এবং তাদের দোসর একটি দেশ এই সুযোগ নেওয়ার জন্য বসে থাকবে। সুতরাং আমাদের একদম অতি বিপ্লবী হলেও চলবে না। একইসঙ্গে কোন কারণে নির্বাচন ‘বিলম্বিত’ না করার বিষয়ে সতর্ক করে তিনি বলেন, আমাদেরকে আপনার প্রতিশ্রুত সময়ে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অবশ্যই নির্বাচন করতে হবে। যার কোনো বিকল্প নাই এই জাতির সামনে। এমন একটা এটমস্ফেয়ার বজায় রাখতে হবে আমাদেরকে, যে এটমস্ফেয়ার আর কখনও পতিত স্বৈরাচারকে সুযোগ নিতে দেবে না। যেভাবেই হোক দীর্ঘদিন অনির্বাচিত অবস্থায় সরকার পরিচালিত হলে যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, সেটা এখনও হয়েছে। সালাহউদ্দিন বলেন, সেজন্য আমরা বারবার তখন থেকেই পারসু করছিলাম, বলছিলাম যত শীঘ্র সম্ভব নির্বাচিত একটা রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। তা না হলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যা কিছু দেখা গেছে, যা কিছু লক্ষণ, সে লক্ষণ এদেশেও উৎপত্তি হবে এবং হয়েছেও তাই। এখন আরও বিলম্বিত হলে আরও বেশি সমস্যা উদ্ভবের সম্ভাবনা বিস্তর।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ নেতা প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে বলেন, এখন জাতীয় নির্বাচনের আগে চার মাস বাকি। দুই মাস আগে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। তার আগে থাকে দেড় দুই মাস। সে সময়ের মধ্যে আরেকটা বিশাল আয়োজন জাতীয় সংসদের নির্বাচনের মত বাস্তবায়ন করা, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সেটা কতটুকু বাস্তব? এবং ফলাফল একই। সারা দেশের জনগণ সংস্কারের জন্য বসে আসে। সংস্কারের পক্ষে। সমস্ত রাজনৈতিক দল সংস্কারের পক্ষে। জাতি পক্ষে। এখানে নেগেটিভ ভোট কয়টা পড়বে হাতে গোনা যাবে। সবাই পজিটিভই দেবে।
তাহলে একত্রে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন না হওয়ার আলোচনা কেন, সেই প্রশ্ন তুলে সালাহউদ্দিন বলেন, একই দিনে ছোট্ট ব্যালটে যদি গণভোট হয়, তাহলে আমাদের জন্য সুবিধাজনক। এবং আলাদা ব্যয়ও হবে না। আলাদা ম্যানপাওয়ারও সেট করা লাগবে না। আলাদা নির্বাচনি বাঙও হবে না। আলাদা বুথ সেন্টারও হবে না। অনেক কিছুই হবে না, আলাদা না হলে। আমরা মনে করি, যারা গণভোট আগে চাচ্ছে, এটা কতটুকু যৌক্তিক তা আপনারাই বিবেচনা করে দেখবেন এবং এটা নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়াস হলেও হতে পারে। আমাদের কাছে তাইই মনে হয়। সকল বিষয়ে আলাদা আলাদা প্রশ্ন সম্বলিত ব্যালটের মাধ্যমে গণভোটের বিপক্ষে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, এখন যদি সব বিষয়ে গণভোট হয় তাহলে তো আর ব্যালট হল না।
সালাহউদ্দিন বলেন, আজকে কেন মাননীয় উপদেষ্টা আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, আমি আমার ভাই আখতার (জাতীয় নাগরিক পার্টির–এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন) বক্তব্য দেওয়ার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। তো আখতার বক্তব্য দেওয়ার পর বুঝলাম, এখানে কিছু সমস্যা হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর সংক্রান্ত বিষয়ে। তারপর এসে জামায়াতের নেতা আকন্দ (জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ) সাহেব যেটা বললেন, তাতে এটা সমৃদ্ধ হয়েছে। তার আগ পর্যন্ত যে সমস্ত নেতৃবৃন্দ বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে মনে হয়েছে, জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের আগে এটা একটা ওয়ার্ম আপ প্রোগ্রাম। তিনি বলেন, আমার মনে হয়েছিল মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আপনি জাতিসংঘের সফরের সময়ে জনাব আখতার হোসেনকেও সাথে নিয়ে গেছিলেন। তারা হয়ত অনেককিছু বিষয়ে আপনার থেকে শিক্ষা পাবেন। আশ্বস্ত হবেন আপনার থেকে। আমরাও শেষে আশ্বস্ত হতে পারব। কিন্তু এখন দেখতেছি, আমরা সারারাত যা বললাম, সকাল বেলা উঠে আবার এটার রিপিটেশন। সেটা করা মনে হয়, আমাদের উচিত হবে না।
স্বাক্ষরের প্রাক্কালে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকা বিষয়গুলোও জুলাই সনদের রাখার সমালোচনা করেন সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবই সবাই মেনে নিলে তো আর ১২ মাস আলোচনার দরকার ছিল না। সবাই সবকিছুতে একমত হলে তো এ চর্চার আর দরকার ছিল না মাননীয় উপদেষ্টা। আর সবগুলো প্রস্তাব, যেগুলো শ্রদ্ধেয় বদিউল আলম মজুমদার সাহেব দিয়েছেন আরকি, এগুলো সব কিতাবে মানায়। বাস্তবের সাথে সেটার অনেককিছুর মিল ছিল না, যেটা আলোচনায় দেখা গেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেগুলো সম্ভব, আমাদের কালচারাল স্ট্যাটাসে যেগুলো সম্ভব, আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে যেগুলো সম্ভব, ইভেন জুডিশিয়াল জাজমেন্টে সেগুলো দেয়, কারণ এটা ব্রিটিশ নয়, এটা আমেরিকা নয়, এটা বাংলাদেশ। এখানে আমাদের ধর্মীয় কালচারকে বিবেচনায় নিতে হয়, আমাদের সামাজিক কালচারকে বিবেচনায় নিতে হয়, আমাদের দীর্ঘদিনের চর্চিত কালচারকে বিবেচনায় নিতে হয়।
তার ভাষ্য, নোট অব ডিসেন্টের স্বাধীনতা তো আপনারাই দিয়েছেন আলাদা আলোচনার মধ্য দিয়ে। এখানে আমরা একত্রিত হয়েছিলাম, আমরা আলোচনা করব এভাবে যে, আমরা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রথম দিন থেকে যেটা বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোসহ সবাই যেসব বিষয়ে একমত হতে পারবে, সেগুলো সংকলিত হয়ে একটা জাতীয় সনদ হবে। এবং এ জাতীয় সনদটা নির্বাচিত সরকারের পার্লামেন্টে বাস্তবায়িত হবে। তার আগে এই সরকারের যেগুলো বাস্তবায়নের সুযোগ থাকবে, অর্ডিন্যান্স জারির মধ্য দিয়ে, নির্বাহী আদেশের মধ্য দিয়ে, সেগুলো বাস্তবায়িত হবে। ইতোমধ্যে অনেক হয়েছে। এবং হচ্ছে প্রতিনিয়ত এগুলো। সুতরাং একটা সংসদ অতি অবশ্য জরুরি সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য।