প্রবাহ

ইউটিউব-ফেসবুকে অতিরিক্ত এবাদত করার ব্যাপক প্রচার!

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৫ অক্টোবর, ২০২৫ at ৪:৪৬ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি ইউটিউব ফেসবুকে ধর্মীয় বিজ্ঞজনের পাশাপাশি অনেকে অতি আগ্রহ করে হয়ত বা সাওয়াবের নিয়তে অতিরিক্ত বিভিন্ন আমলের কথা বলছে। এতে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাতে মোয়াক্কাদার পাশাপাশি দৈনন্দিন অন্যান্য আমল করার জন্য মুসলমান নরনারীকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। সাথে সাথে রমজান মাসের ফরজ রোজার পরেও চন্দ্র অপর ১১ মাসে কোন সময় কোন রোজা রাখলে অত্যধিক সাওয়াব পাওয়া যায় তাও ইউটিউব, ফেসবুকে প্রচারণা লক্ষ্য করছি। উক্ত দৈনন্দিন আমল ও রমজান মাস বাদে অন্য মাসে অতিরিক্ত রোজা রাখা বিষয়ে যৌবনকাল থেকে তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে বেশি বেশি জেনে আসছিলাম। অবশ্য চন্দ্র মাসে বিভিন্ন তারিখে রোজা রাখার চেয়ে তাবলীগ জামাত দৈনন্দিন নফল এবাদতের কথা বেশি বলেন মনে হয়। এও শুনে আসছিলাম দৈনন্দিন এই এবাদত করলে এত লক্ষ কোটি সাওয়াব এই এই এবাদত করলে এই এই সাওয়াব।

ফেসবুক, ইউটিউবে প্রচারনায় তাবলীগ জামাতের চেয়ে ধর্মীয় বিজ্ঞজন ও সাধারণ ধার্মিকগণের মাধ্যমে অতিরিক্ত এবাদতের উপর প্রচারণা ব্যাপকতা লাভ করে।

অতি সম্প্রতি বেশ কয়েকজন নরনারী রমজান মাস বাদে অন্য ১১ চন্দ্র মাসে কোন তারিখে কি কি রোজা রাখতে হবে তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।

অর্থাৎ দৈনন্দিন নামাজ, দরূদ শরীফ ও এস্তেগফারসহ বিভিন্ন আমল সাথে সাথে চন্দ্র ১১ মাসে অতিরিক্ত রোজা রাখার ব্যাপারে প্রচারণা দিন দিন বাড়তেই আছে।

অসংখ্য নরনারী নিশ্চিত সাওয়াবের নিয়তে এই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তাতে সন্দেহ নেই।

বিষয়টি নিয়ে ভাবি। আল্লাহর রসূল (.)’র ২৩ বছরের নবুওয়াত জীবন বিশেষ করে পবিত্র মদিনায় ১০ বছরের নবুওয়াত জিন্দেগীতে অনেক সাহাবা আল্লাহর রসূল (.) থেকে জানতে চেয়েছেন, দৈনন্দিন কি কি আমল করবে। যা বোখারী শরীফ, মুসলিম শরীফে উল্লেখ পাওয়া যাবে। আল্লাহর রসূল (.) ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাতে মোয়াক্কাদার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। আরও এবাদতের গুরুত্ব যে নিই তা নয়।

এক সাহাবা আল্লাহর রসূল (.) কে প্রশ্ন করেছিলেন, আমাকে এমন কিছু আমল শিখিয়ে দেন, আমি এর বেশিও করব না, কমও করব না। তখন আল্লাহর রসূল (.) ফরজ ওয়াজিব সুন্নতের কথা বলেছেন। ঐ সাহাবা তা জপে জপে যাচ্ছিলেন আমি এর বেশিও করব না, কমও করব না। আল্লাহর রসূল (.) এই সাহাবার পরকালের সুসংবাদ দিয়ে ছিলেন।

আজকের লেখার মূল উদ্দেশ্যে বলতেছি

উপরে উল্লেখিত সমস্ত আমল মহান আল্লাহপাকের। কিন্তু আল্লাহপাক পরকালে বান্দার দু’টি বিষয় ক্ষমা করবেন না।

. শিরক। যথাযারা মহান আল্লাহপাকের সাথে অন্য কাউকে সমতুল্য মনে করা বা ঐ জাতীয় কাজ করা।

. বান্দার হক। একালে মুসলমান যে বান্দার হক কি, তার গুরুত্ব, বান্দার হকের কারণে পরিণাম কি হতে পারে তা মনে হয় সম্পূর্ণ অবহেলায় অজ্ঞতায়। ধর্মীয় বিজ্ঞজন টুপি দাড়ি বোরকাওয়ালা নরনারী তাদের মধ্যে দিনেরাতে অতি এবাদতী কোটি কোটিজন পাওয়া যাবে। আরও পাওয়া যাবে রমজানের পর অপর ১১ চন্দ্র মাসে বিভিন্ন তারিখে নফল রোজা রাখা নরনারী। কিন্তু পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করছেন, হালাল রোজগারে আছেন, হালালহারাম পার্থক্য করে চলছেন এ রকম ব্যক্তি হাজারে কয়জন পাওয়া যাবে! অফিসআদালতে কলকারখানায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লেনদেনে হাজারে কয়জন লোক বাছবিচার করে চলছে। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতির উপর মনে হয় দেশ ভাসছে। তার উপর পাড়া মহল্লায় গ্রামে গঞ্জে, শহরে বন্দরে চাঁদাবাজিতে জনগণ অতিষ্ঠ অসহায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এমন পর্যায়ে গেছে, এই সব ক্ষেত্রে সরকারও মনে হয় অসহায়।

আফসোসের বিষয়, ইউটিউব ফেসবুকে হালালহারাম বিষয়ে প্রচার খুবই সীমিত। সব চাইতে অবাক করা ব্যাপার ইউটিউব, ফেসবুকের প্রচার শুনে শুনে মানুষ অতিরিক্ত এবাদত করতে উদ্‌বুদ্ধ হচ্ছে। সাথে সাথে চন্দ্র মাসে অতিরিক্ত নফল রোজা রাখছে।

উক্ত বিষয় যে, মানবের কল্যাণকর তাতে কোন সন্দেহ নেই। এবাদতকারীগণের মধ্যে হালালহারাম পার্থক্য করছে, হারামকে ভয় করছে, এ রকম লোক হাজারে কয়জন পাওয়া যাবে!

দেশের প্রেক্ষাপট এমন অবস্থায় উপনীত হয়েছে, হালালহারাম পার্থক্য এটা ইসলাম ধর্মে মুসলমানদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। টুপি, দাড়ি, বোরকা, দৈনন্দিন বেশি বেশি এবাদত, প্রতি মাসে নফল রোজা রাখাতে মনের মধ্যে অত্যধিক প্রশান্তি লাভ করছে। কিন্তু সুদ, ঘুষ, দুর্নীতিতে জীবনকে গ্রাস করে ফেলছে তার জন্য অনুশোচনা ত নয়ই, ইহা ইসলামের মৌলিক বিষয়ের মধ্যে আছে বলে মনে করছে না।

এক ব্যক্তি দেশে কিংবা বিদেশে থাকুক না কেন, তিনি চন্দ্র মাসে নির্দিষ্ট দিনসমূহে রোজা রাখার বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে মনে হয় ভুল হয় না। একবার তাকে মোবাইলে বলেছিলাম, আপনি নকল রোজা রাখার কথা বারে বারে বলছেন, সুদ, ঘুষ হারাম ইনকাম এ নিয়ে কিছু বলছেন না। মনে হয় তিনি আমার কথায় খুশি হলেন না।

আমাদের দেশে ঘুষ, সুদ, দুর্নীতির ব্যাপকতাটা ১৯৮০ এর দশক থেকে। মনে হয় তার আগে মানুষের জীবনযাত্রা যেমন সহজ ছিল তেমন দুনিয়ার প্রতি মোহ ছিল কম। দুনিয়া পাওয়ার মোহে সন্তানের প্রতি দুর্বলতা আমাদেরকে গ্রাস করে ফেলছে। সন্তানের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়ছে; হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। পিতার ইন্তেকালের পর সন্তানেরা তাদের সন্তানের কল্যাণে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য বলা যাবে। পিতার কথা দ্রুত ভুলে যায়।

হাশরের ময়দানে ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি। কেউ কারও নয়। স্বামীস্ত্রীর নয়, স্ত্রীস্বামীর নয়। পিতামাতা পুত্রকন্যার নয়, পুত্রকন্যা পিতামাতার নয়।

জীব মাত্রই মরণশীল। মনে হয় এই অনুভূতিটা আমাদের কাজ করছে না। অনুভূতি কাজ করলে আমরা হালালহারাম, ঘুষ, সুদ, দুর্নীতিকে ভয় করতাম। অপরদিকে হাজারে ২/১ জন যারা হালালের উপর থাকতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদের জন্য কঠিন অবস্থা বলা যাবে। তাদের জীবন প্রবাহ এত যে কঠিন হয়ে গেছে মহান আল্লাহপাক হেফাজত না করলে তাদের অবস্থা কি হবে তা নিয়ে ভাবি।

হালালহারাম ব্যবধান মেনে চলা নফল ইবাদতের চেয়ে বহু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মহান আল্লাহপাক বলেন-“তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের অর্থসম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ কর না এবং মানুষের ধনসম্পদ জেনে শুনে অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করার জন্য তা বিচারকগণের নিকট পেশ কর না।

আল্লাহর রসূল (.) বলেন,বৈধ জীবিকার ইবাদত ছাড়া কোন এবাদত আল্লাহর নিকট উঠানো হয় না। তিনি আরও বলেন, ওযু গোসল ছাড়া যেমন নামাজ কবুল হয় না তেমনি অবৈধ সম্পদের কোন দান বা খরচ কবুল হয় না।

যে ব্যক্তি অবৈধ সম্পদ সঞ্চয় করে এরপর দান করবে সে এই দানের জন্য কোন সাওয়াব পাবে না এবং তার পাপ তাকে ভোগ করতে হবে।

হযরত ইবনে আব্বাস (.) কে প্রশ্ন করা হয়, এক ব্যক্তি একটি প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিল, তখন সে জুলুম করে অবৈধভাবে ধন সম্পদ উপার্জন করে। পরে সে তওবা করে এবং সেই সম্পদ দিয়ে হজ্ব করে দান করে এবং বিভিন্ন জনকল্যাণ মূলক কাজে ব্যয় করে; তখন হযরত ইবনে আব্বাস (.) বলেনহারাম রোজগার কখনও পাপ মুছন করে না। বরং হালাল টাকা থেকে ব্যয় করে মুছন হয়।

বর্তমানকালে বাস্তবতা বড় কঠিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পাপে লিপ্ত ব্যক্তি অগণিত মানুষের ওজন কম দিয়েছেন, ঘুষ নিয়েছেন, সরকারের বা জনগণের সম্পদ গ্রাস করেছেন, কর্মে ফাঁকি দিয়েছেন এখন তিনি কিভাবে তাদের ছিনবেন বা তাদেরকে সম্পদ ফেরত দিবেন। এই ক্ষেত্রে তিনি তিনটি কাজ করতে পারেন।

. সকল অবৈধ উপার্জন সম্পূর্ণরূপে বর্জন করবেন

. অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পূর্ণ অর্থ সম্পদ মজলুম বা যাদের থেকে নিয়েছেন তাদের পক্ষ থেকে ব্যয় বা দান করবেন। এতে কখনও নিজের সাওয়াবের আশা রাখবেন না। তবে হয়ত আল্লাহপাক দয়া করে এর সাওয়াব মাজলুমদেরকে প্রদান এবং তাকে পাপ মুক্ত করবেন।

. আল্লাহপাকের নিকট বেশি বেশি ক্ষমতা চাইবেন

বস্তুতঃ যারা ফেসবুকে ইউটিউবে নফল রোজা নফল এবাদতের জন্য প্রচার চালাচ্ছেন তাদের মধ্যে হাজারে কয়জন হালাল রোজগারে আছেন ভাবতে হবে। নফল ইবাদত নফল রোজার গুরুত্ব এর চেয়ে হালাল রোজগার, হালালহারাম পার্থক্য করে আয় রোজগারের কথা বেশি বেশি প্রচার করুন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোহিঙ্গা সংকট ও স্কুল ফিডিং কর্মসূচি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ডব্লিউএফপি প্রধানের বৈঠক
পরবর্তী নিবন্ধসততা ও নৈতিকতার অনন্য আদর্শ : মাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরী