৭২ ঘণ্টার মধ্যে বর্ধিত ট্যারিফ বাতিলে নোটিশ

তিন মন্ত্রণালয় ও বন্দর চেয়ারম্যানকে নোটিশ দিয়েছে মেরিটাইম ল’ সোসাইটি ।। স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে যৌথ পরামর্শ কমিটি গঠনের দাবি ।।প্রধান উপদেষ্টাকে বন্দর ব্যবহারকারীদের চিঠি

হাসান আকবর | বুধবার , ১৫ অক্টোবর, ২০২৫ at ৪:১৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তাবিত নতুন ট্যারিফ কাঠামো স্থগিত ও বাতিলের দাবিতে ব্যবসায়ী ও পোর্ট ইউজার্স ফোরামের পাশাপাশি এবার সরাসরি আইনি আল্টিমেটাম দিয়েছে বাংলাদেশ মেরিটাইম ল’ সোসাইটি (বিএমএলএস)। সংগঠনটি গতকাল মঙ্গলবার সরকারের সংশ্লিষ্ট তিন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বন্দর চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ প্রেরণ করে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ট্যারিফ বিষয়ক সার্কুলার ও এসআরও বাতিলের দাবি জানিয়েছে। অন্যথায় হাই কোর্টে রিটসহ আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তারা। এদিকে বন্দর ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকেও গতকাল প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে জরুরি পত্র দিয়ে বর্ধিত ট্যারিফের সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন সেবা খাতে বর্ধিত ট্যারিফ গতকাল মধ্যরাত থেকে কার্যকর করা হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ গড়ে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে বলেছে, বন্দরের ব্যয় নির্বাহের জন্য ট্যারিফ বাড়ানোর কোনো বিকল্প তাদের সামনে নেই। ১৯৮৬ সালের পর এই ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হলো।

কিন্তু ট্যারিফ বৃদ্ধির ব্যাপারে শুরু থেকে আপত্তি জানিয়ে আসছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিসহ বন্দর ব্যবহারকারীরা একসাথে বিপুল পরিমাণ ট্যারিফ না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাড়ানো এবং কমপক্ষে এক বছর সময় দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের বৈঠক করে বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট অনুরোধ জানান। চিঠিপত্রের মাধ্যমেও অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু সরকার গত ১৪ সেপ্টেম্বর বর্ধিত ট্যারিফের প্রজ্ঞাপন জারি করে ওইদিন থেকে তা কার্যকর করার সিদ্ধান্ত দেয়। পরবর্তীতে ওই প্রজ্ঞাপন এক মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। এক মাস সময় পার হওয়ার পর গতকাল মধ্যরাত থেকে ট্যারিফ কার্যকর করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে পোর্ট ইউজার্স ফোরামের আহ্বায়ক আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী প্রধান উপদেষ্টার বরাবরে গতকাল জরুরি এক পত্রে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ২০২৫ সালের প্রস্তাবিত ট্যারিফ পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানান। আবেদনপত্রে জানানো হয়, ৩০ সেপ্টেম্বর জারি করা সার্কুলার নং ১৮.১৩.০০০০.৫৫১.৩১.০০৯.১৯/৪৭ এবং ১৪ সেপ্টেম্বরের এসআরও নং ৩৬৪আইন/২০২৫ এর আওতায় গড়ে প্রায় ৪১ শতাংশ পর্যন্ত নতুন মাশুল আরোপ করা হচ্ছে, যা ১৫ অক্টোবর থেকে কার্যকর করা হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ১৯৮৬ সালে সর্বশেষ ট্যারিফ প্রণয়নের সময় ডলারের বিনিময় হার ছিল প্রতি ডলারে ৩০ টাকা ৬১ পয়সা, যা বর্তমানে ১২২ টাকার বেশি। ফলে বিদ্যমান ট্যারিফই প্রকৃত অর্থে চার গুণের বেশি বেড়ে গেছে। এরপরও গত কয়েক দশকে হ্যান্ডলিং, পাইলটেজ, ডেমারেজসহ বিভিন্ন সেবায় ধারাবাহিকভাবে বাড়তি চার্জ আরোপ করা হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর একটি সেবামুখী প্রতিষ্ঠান এবং বিদ্যমান ট্যারিফ থেকেই অর্থনৈতিক সক্ষমতা গড়ে উঠেছে। তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, প্রস্তাবিত ট্যারিফ বাস্তবায়িত হলে রপ্তানি ব্যয় বাড়বে, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পেছাবে, ইজি অফ ডুয়িং বিজনেস সূচক এবং লজিস্টিকস পারফরম্যান্স ইনডেঙে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া দেশীয় শিল্প, গম, সার, জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম বাড়বে, যা উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করবে। আন্তর্জাতিক শিপিং কমিউনিটির কাছে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যয়বহুল আখ্যায়িত হবে এবং গ্রহণযোগ্যতা ও আস্থা কমে যাবে।

চিঠিতে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা করে পর্যায়ক্রমে যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক ট্যারিফ কাঠামো নির্ধারণের আহ্বান জানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কাঠামোগত উন্নয়ন এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে সেবাভিত্তিক এবং অলাভজনক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।

অপরদিকে বাংলাদেশ মেরিটাইম ল’ সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মহিউদ্দিন আবদুল কাদির তিনটি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবরে প্রেরিত উকিল নোটিশে বলা হয়, ২০ ফুট কন্টেনারপ্রতি গড় চার্জ ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকায় উন্নীত হয়েছে। আমদানি কন্টেনারে ৫ হাজার ৭২০ টাকা এবং রপ্তানি কন্টেনারে ৩ হাজার ৪৫ টাকা বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। এছাড়া জাহাজ থেকে কন্টেনার ওঠানামার প্রতি ইউনিট চার্জ ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৬৮ ডলার করা হয়েছে।

নোটিশে অভিযোগ করা হয়েছে, ট্যারিফ মার্কিন ডলারে নির্ধারিত হওয়ায় ডলারটাকা বিনিময় হারের পতনের ফলে ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। এর প্রভাবে আমদানিরপ্তানি বাণিজ্য ছাড়াও দেশের ভোগ্যপণ্য সরবরাহ, শিল্প কাঁচামাল, উৎপাদন ব্যয় এবং মূল্যস্ফীতিতে চাপ পড়বে।

বিএমএলএসের নোটিশে আরো অভিযোগ করা হয়, ট্যারিফ নির্ধারণে যেসব পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যুক্ত ছিল, তাদের কারো বন্দর ব্যবস্থাপনা বা মেরিটাইম খাতে দক্ষতা নেই। পরামর্শক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও প্রক্রিয়াগত বৈধতা মানা হয়নি। এছাড়া পোর্ট অ্যাক্ট ১৯০৮এর ৩৩() ধারায় গেজেট প্রকাশের ৬০ দিন আগে ট্যারিফ কার্যকর না করার বিধান থাকলেও ১৪ সেপ্টেম্বরের এসআরও ১৪ অক্টোবর থেকে কার্যকর করা হয়েছে, যা আইন বহির্ভূত ও অবৈধ।

বিএমএলএস ও সংশ্লিষ্ট অংশীদাররা ট্যারিফ কার্যকর স্থগিত রেখে পুনর্বিবেচনার জন্য স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে যৌথ পরামর্শ কমিটি গঠনের দাবি করেছেন। তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প ট্যারিফ ইস্যুতে সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য রপ্তানি খাতে স্বস্তি এনেছে। অথচ দেশে নিজেরাই ট্যারিফ বাড়ালে তা হবে আত্মঘাতী পদক্ষেপ।

সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে দেশের অর্থনীতি ও জনস্বার্থ রক্ষায় আইনি লড়াই শুরু করা হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, বর্ধিত ট্যারিফ গত মধ্যরাত থেকে কার্যকর করা হয়েছে। সরকার যদি নতুন কোনো নির্দেশনা প্রদান করে তাহলে ওভাবে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে ছাত্রদল নেতা নিহত
পরবর্তী নিবন্ধএবার ফ্রেট রেট সমন্বয়ের ঘোষণা এইচআর লাইনসের