প্রচারণা শেষ, এখন ভোটের অপেক্ষা

শেষ দিনের প্রচারণায় উৎসবের আমেজ ব্যতিক্রমী কৌশলে ভোট চাওয়ায় ব্যস্ত প্রার্থীরা

শামীম হোসাইন, চবি | মঙ্গলবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২৫ at ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘ তিন যুগ পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। গতকাল সোমবার রাত ১২টায় শেষ হয় চাকসু নির্বাচনের ১৮দিনের প্রচারণা। আগামীকাল বুধবার ভোট। এখন ভোটের অপেক্ষা। প্রচারণার শেষ দিনে গতকাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রার্থীদের ব্যস্ত পদচারণায় মুখর ছিল গোটা ক্যাম্পাস। জিরো পয়েন্ট, স্টেশন, কলার ঝুপড়ি থেকে শুরু করে একাডেমিক ভবন, অনুষদ ও হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কোণায় ছিল নির্বাচনী উৎসবের আমেজ।

প্রার্থীরা শেষ মুহূর্তে ভোটারদের কাছে নিজেদের পরিচিতি ও ইশতেহার তুলে ধরতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। কেউ গেয়ে শুনিয়েছেন প্রচারণার গান, কেউ নাটক মঞ্চস্থ করেছেন, কেউ আবার রঙিন পোস্টার ও প্রতীকের লিফলেট বিলি করেছেন। কারও হাতে পাখা, কারও গলায় গিটার, আবার কারও মুখে হাসি আর স্লোগান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যেন পরিণত হয়েছিল এক প্রাণবন্ত নির্বাচনী মেলায়। শিক্ষার্থীরাও প্রার্থীদের এমন প্রচারকে প্রশংসা করছে হরহামেশাই।

চাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল প্যানেলের এজিএস প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান তৌফিক বলেন, ডাকসু বা জাকসুর মতো চাকসুতেও কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেনি, যা শিক্ষার্থীদের কাছে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। আশা করি শিক্ষার্থীরা ভোট কেন্দ্রে এসে তাদের যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবে। ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেল’এর সহদপ্তর সম্পাদক পদপ্রার্থী মেহেদী হাসান সোহান বলেন, দীর্ঘদিন পর এমন নির্বাচনে অংশ নিতে পারছি, এটা আমাদের জন্য আনন্দের। আমরা চাই সুশৃঙ্খল ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হোক। প্রার্থীদের ভিড় থেকে যোগ্য যে হবে তাকে ভোটাররা খুঁজে বের করুক। যোগ্যদের নেতৃত্ব তুলে দিক।

অনেক শিক্ষার্থী নিজের পছন্দের প্রার্থীর জন্য প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহিদুল ইসলাম শুভ বলেন, আমরা চাই স্বচ্ছ ভোট হোক, ব্যালট হাতে গণনা করা হোক। অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ শাটল ট্রেন থাকলে ভোটে অংশগ্রহণ আরও বাড়তো। মাহিদ নামে আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, আমি আমার বন্ধুর ভোটের প্রচারণা করতেছি। ভোটার থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছি। ভোটারদের কাছে গেলেই শুনি তারাও উৎসুক হয়ে আছেন ভোট দেওয়া জন্য। তারাও চায় যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে প্রশাসন থেকে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে যোগ্য ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব দিতে।

বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সবাই এখন শেষ মুহূর্তের কৌশল ঠিক করতে ব্যস্ত। কেউ ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে নিজের ইশতেহার তুলে ধরছেন, কেউ আবার ডরমিটরির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন।

ছাত্রী কল্যাণ সম্পাদক পদপ্রার্থী সায়মা আফরোজ বলেন, দীর্ঘ ৩৫ বছর পর এমন একটা ঐতিহাসিক নির্বাচন হচ্ছে এতে অংশ নিতে পারছি, এটা গর্বের বিষয়। আমরা চাইছি মেয়েদের অংশগ্রহণ আরও বাড়ুক এবং তাদের বাস্তব সমস্যাগুলো যেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করেন। অন্যদিকে, ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী সাইফুল ইসলাম রাব্বি বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুব সচেতন। তারা প্রার্থীদের কাজ, মনোভাব ও অঙ্গীকার বিবেচনা করেই ভোট দেবেন। প্রার্থীদের যোগ্যতাটা এখানে মূখ্য বিষয়। আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছি, তাদের আস্থা অর্জনের জন্য। আশা করছি শিক্ষার্থীরা আমাকেসহ আমার প্যানেলকে হতাশ করবে না।

প্রচারণায় নাটক, গান, কাওয়ালী ও মুখাভিনয় : শেষ দিনের প্রচারণায় প্রার্থীরা নিয়েছেন নানা ব্যতিক্রমী কৌশল। কেউ গাইছেন গান, কেউ নাটক মঞ্চস্থ করছেন, কেউ আবার কাওয়ালী বা মুখাভিনয়ের মাধ্যমে ভোটারদের আকৃষ্ট করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী উলফাতুর রহমান রাকিব, সহসাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদপ্রার্থী, পুরো ক্যাম্পাসে ‘চার্লি চ্যাপলিন’ রূপে মুখাভিনয়ের মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়েছেন। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ থেকে কলা অনুষদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি স্থানে ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থীদের হাসিয়েছেন, ভাবিয়েছেন। এর আগে তিনি রাজশাহীর বিখ্যাত লোকনাট্য গম্ভীরার ‘নানা’ চরিত্রে অভিনয় করে প্রচারণা চালিয়েছিলেন।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি চাই শিক্ষার্থীরা প্রচারণাকে বিরক্তিকর নয়, আনন্দদায়কভাবে গ্রহণ করুক। তাই সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার মাধ্যমে আমার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি।

কাওয়ালীর সুরে প্রচারণা: ‘অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল স্টেশনতলায় আয়োজন করে কাওয়ালী পরিবেশনার। বিকেলে তাদের সুরে মুখর হয় চারপাশ। অনেক শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেন এই ভিন্নধর্মী প্রচারণা। ভোটার সায়েম বলেন, এভাবে প্রচারণা করলে ভোটারদের মন সহজে জয় করা যায়। এমন আয়োজন খুব উপভোগ্য।

গান ও পথনাটকের মঞ্চায়ন : এদিকে ‘দ্রোহ পর্ষদ’এর প্রার্থীরা প্রচারণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেল স্টেশনে নতুন মাত্রা যোগ করে গান ও পথনাটকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করছেন। নাটক আর স্লোগানে তারা তুলে ধরেছেন ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস, শিক্ষার্থীদের দাবি আর পরিবর্তনের অঙ্গীকার। তাদের এই ব্যতিক্রমী প্রচারণাকেও শিক্ষার্থীরা স্বাগত জানিয়েছেন। জানতে চাইলে এক ভোটার বলেন, দ্রোহ পর্ষদের এই ব্যতিক্রমী আয়োজন শিক্ষাদের মন যোগাতে পারে। আশা করি শিক্ষার্থীরা ভালো একটা ফলাফল উপহার দিবেন।

স্কেটিং করে ভোট চাওয়া: সহসাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক পদপ্রার্থী অন্তর মণ্ডল স্কেটিং করে প্রচারণা চালিয়ে নজর কাড়েন। তিনি লুঙ্গি পরে ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজের ইশতেহার তুলে ধরেন। অন্তর বলেন, শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ও আনন্দ দিতে চেয়েছি। আমি ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি এবং আশাবাদী।

ফুসফুস আকৃতির লিফলেট : স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী আফনান হাসান ইমরা তার প্রচারণায় ব্যবহার করেছেন ফুসফুস আকৃতির লিফলেট। এতে তার ইশতেহার ও স্বাস্থ্য সচেতনতার বার্তা তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বিষয়ক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি, তাই স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রতীক ফুসফুসের আদলে লিফলেট করেছি।

নির্বাচনী আমেজে উৎসবের রঙ ছড়ালেও ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে প্রশাসনের প্রস্তুতিও নজর কাড়ছে। সর্বত্র টাঙানো হয়েছে আচরণবিধি সংক্রান্ত ব্যানার, বিভিন্ন কমিটির তদারকি চলছে নিয়মিত।

চাকসুর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৫১৬ জন। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আয়োজিত এই নির্বাচনে ১৩টি প্যানেল থেকে সহসভাপতি পদে ২৪ জন, সাধারণ সম্পাদক পদে ২২ জন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে ২১ জন, খেলাধুলা সম্পাদক পদে ১২ জন, সহ সম্পাদক পদে ১৪ জন, সাহিত্যসংস্কৃতি সম্পাদক পদে ১৭ জন, সহ সম্পাদক পদে ১৫ জন, দপ্তর সম্পাদক পদে ১৭ জন, সহ সম্পাদক পদে ১৪ জন, ছাত্রী কল্যাণ সম্পাদক পদে ১৩ জন, সহ সম্পাদক পদে ১০ জন, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পাদক পদে ১১ জন, গবেষণা ও উদ্ভাবন সম্পাদক পদে ১২ জন, সমাজসেবা ও পরিবেশ সম্পাদক পদে ২০ জন, স্বাস্থ্য সম্পাদক পদে ১৫ জন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে ১৭ জন, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক পদে ১৬ জন, যোগাযোগ ও আবাসন সম্পাদক পদে ১৭ জন, সহ সম্পাদক পদে ১৪ জন, আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক পদে ৯ জন, পাঠাগার ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ২০ জন, আর নির্বাহী সদস্য পদে প্রার্থী হয়েছেন ৮৫ জন।

এ ছাড়া, হল সংসদ নির্বাচনে ৯টি ছাত্র হলে ৩৫০ জন এবং পাঁচটি ছাত্রী হলে ১২৩ জন বিভিন্ন পদে লড়বেন। শিল্পী রশিদ চৌধুরী হোস্টেলে ২০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

সব মিলিয়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এখন এক নির্বাচনী উৎসবে পরিণত হয়েছে। লিফলেটের ঘূর্ণি, গান আর স্লোগানের সুরে মুখর ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা অপেক্ষায় ৩৫ বছর পরের সেই ঐতিহাসিক দিনের, যেদিন ভোটের বাক্সে জমা হবে তাদের প্রত্যাশা, পরিবর্তন আর স্বপ্নের প্রতিফলন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য ও গভীরতা আন্তর্জাতিক ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধসড়ক থেকে কাভার্ডভ্যান সরাতে বলায় ট্রাফিক পুলিশের মাথা ফাটাল বিক্রয় প্রতিনিধি