আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ হবে আইকনিক

৩শ কোটি টাকার পুন:নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপনে ধর্ম উপদেষ্টা সরকার থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ, মুসল্লি ও গণমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় পূণ ফান্ড সংগ্রহ করা হবে

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৩ অক্টোবর, ২০২৫ at ৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ

আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদকে একটি আইকনিক মসজিদে পরিণত করা হবে। ঐতিহাসিক এই মসজিদটিকে আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন ও বিশ্বমানের মসজিদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ৩০০ কোটি টাকার পুনঃনির্মাণ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম উদ্বোধন করে ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আজ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম। কাল থেকে মসজিদ পুনঃনির্মাণের কাজ চলবে। গতকাল রোববার দুপুরে মসজিদ প্রাঙ্গণে পুনঃনির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমে মুসল্লি ও চট্টগ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় পূর্ণ ফান্ড সংগ্রহ করা হবে। চট্টগ্রামের মানুষের মন অনেক বড় মন্তব্য করে তিনি বলেন, সবার সহযোগিতা পেলে এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদকে আইকনিক মসজিদে রূপান্তর করতে কোনো অসুবিধা হবে না।

ধর্ম উপদেষ্টা বলেন, নতুন নকশায় ঐতিহাসিক স্থাপনার মূল কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে এটিকে পবিত্র মদিনার মসজিদে নববীর আদলে নির্মাণ করা হবে। এই মসজিদে আমি নামাজ পড়ি। তাই এই মসজিদের প্রতি আমার আলাদা একটা টান আছে। আমরা যদি আমাদের ওআইসিভুক্ত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশকে এই প্রজেক্টটি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারি, আশা করি তাদের কাছ থেকেও ইতিবাচক সাড়া পাব। সেজন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য সহায়তা করা হবে।

মসজিদের ডিজাইন দৃষ্টিনন্দন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্মিত মসজিদে একসাথে ১৪ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে পারবে। প্রতিবন্ধীদের জন্য নামাজ আদায়ের আলাদা ব্যবস্থা থাকবে। মার্কেট থাকবে, অডিটরিয়াম থাকবে, খাদেমমুয়াজ্জিনদের জন্য আবাসন সুবিধাসহ নানা সুবিধা বিদ্যমান থাকবে। তিনি বলেন, এখানে দুটি সমস্যা আছে। মসজিদের জায়গা বেদখল এবং এটিকে সরকার বিশ্ব ঐতিহ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আওতাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপরিকল্পিত স্থাপনার কারণে আমরা এটিকে বাইরে থেকে দেখতে পাই না। তাই এ মসজিদের কাঠামো বিদ্যমান রেখে আমাদের নতুন করে মসজিদ নির্মাণ করতে হবে। এই মসজিদ যদি নামাজ পড়ার অনুপযুক্ত হয়ে যায় বাঁশ দিয়ে হলেও এটিকে রক্ষা করতে হবে। কোনোমতেই এটি ভেঙে ফেলা যাবে না। এটাকে অক্ষুণ্ন রেখে যাতে মুসল্লিরা ইমাম সাহেবকে দেখে নামাজ আদায় করতে পারে সেভাবে মসজিদ নির্মাণ করা হবে। এতে করে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজও রক্ষা পাবে, মসজিদের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পাবে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আব্দুস সালাম খানের সভাপতিত্বে এবং অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মসজিদ মুসল্লি কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিব মাওলানা সাইয়্যেদ আনোয়ার হোসাইন তাহের জাবেরী আল মাদানী ও মসজিদ মুসল্লি কমিটির সভাপতি সালাউদ্দিন কাশেম খান।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, উনারা দুইজনই এই মসজিদকে সহায়তা করেছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া এই মসজিদের জন্য ৭ কোটি টাকা অনুদান প্রদান করেছিলেন। কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের ফখরুদ্দীনমঈনুদ্দীনের সরকার সেই অনুদান বাতিল করে দেয়। এটার জের ধরেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মসজিদ পুনঃনির্মাণে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ক্যানসার ইউনিট স্থাপনে বিশেষ অবদান রাখায় দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের প্রশংসা করে মেয়র বলেন, আমি মনে করি চট্টগ্রামের মহৎ মানুষগুলো পাশে থাকলে এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদকে দৃষ্টিনন্দন মসজিদে পুনঃনির্মাণ করা অসম্ভব কিছু নয়।

দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, এই মসজিদের প্রতি আমার টানটা একটু অন্যরকম। আমার বাবা মরহুম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার এই মসজিদে জামাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। আমাদের বাসা থেকে মসজিদের আজান শোনা যেত। আজান হলে যতই কাজ থাকুক না কেন, কাজ বন্ধ করে তিনি মসজিদে চলে যেতেন। এ সময় এম এ মালেক কিছুটা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।

পবিত্র কোরআন শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে আজাদী সম্পাদক বলেন, মানুষ যা চায় তা করতে পারে। মানুষ চেষ্টা করলে মহান আল্লাহ সহায়তা করেন। চট্টগ্রামবাসী এ পর্যন্ত কোনো প্রজেক্ট হাতে নিয়ে ফেল করেনি। ধর্ম উপদেষ্টা নিশ্চয় আমাদের পাশে থাকবেন। সরকার আমাদের পাশে থাকলে আমরা সফল হব।

ঐতিহ্যবাহী এই জামে মসজিদের আধুনিকায়ন ও পুনঃনির্মাণ যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারসহ সকলের সহযোগিতা চেয়ে মসজিদের খতিব মাওলানা সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন তাহের জাবেরী আল মাদানী বলেন, এই মসজিদে আমি ৩০ বছর ধরে আছি। কিন্তু নানাভাবে এই মসজিদ বঞ্চিত হয়েছে, হিংসার শিকার হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় মসজিদের দোতলা আমরা তালাবদ্ধ করে রাখতে বাধ্য হয়েছি। এখন প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রামের, ধর্ম উপদেষ্টা চট্টগ্রামের। আপনাদের আমলে যদি এই মসজিদের উন্নয়ন না হয় তাহলে আপনাদেরকেই একদিন জবাব দিতে হবে। তিনি বলেন, সবার আন্তরিক সহযোগিতা থাকলে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ পুনঃনির্মাণ কাজ শেষ করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ।

মসজিদের মুসল্লি কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান চৌধুরী বলেন, এই মসজিদের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। প্রায় ৫শ বছরের পুরনো এই মসজিদকে সানিয়ে কাবা আখ্যা দেয়া হয়েছে। এই মসজিদ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তিনি মসজিদটি পুনঃনির্মাণ কাজে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা চান। তিনি বলেন, বর্তমানে যেখানে প্রায় ৩ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন, সেখানে নতুন প্রকল্পে ১৪ হাজারের বেশি মুসল্লির নামাজের ব্যবস্থা থাকবে। নারীদের জন্য ৫০০ জনের পৃথক নামাজের স্থান এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ প্রবেশ পথ নির্মাণ করা হবে।

তুরস্কের চট্টগ্রামস্থ অনারারি কনসাল একে খান গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং মসজিদের মুসল্লি কমিটির সভাপতি সালাউদ্দিন কাশেম খান বলেন, ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মারক হিসেবে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে সুবেদার শায়েস্তা খাঁ এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। সময়ের পরিক্রমায় মসজিদটির ধারণক্ষমতা কমে আসা এবং কিছু অংশ জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় মুসল্লিদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন নকশায় মসজিদের মূল ঐতিহাসিক স্থাপনা অক্ষুণ্ন রেখেই আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের অপূর্ব সমন্বয় ঘটানো হবে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আব্দুস সালাম খান বলেন, মসজিদে নববীর আদলে এই মসজিদ পুনঃনির্মাণের উদ্যোগে সরকার আন্তরিক। এই আন্তরিকতাকে কাজে লাগিয়ে সবার সহযোগিতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এই শাহী জামে মসজিদ আবারও হয়ে উঠবে মুসলিম সমাজের সংস্কৃতি, শিক্ষা ও ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র।

উল্লেখ্য, ঢাকার স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান এইজ অ্যান্ড এজ আর্কিটেকচার স্টুডিওর স্থপতি সাদিকুল বাশার ও সাবরিনা আফতাব মসজিদে নববীর আদলে এই দৃষ্টিনন্দন নকশা প্রণয়ন করেছেন। মোগল ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সংযোগ ঘটানো হয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরে ইবাদতের শান্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডিসেম্বরের মধ্যে বন্দরের ২ টার্মিনালের দায়িত্বে বিদেশি অপারেটর
পরবর্তী নিবন্ধবান্দরবানে ডাকা আজকের হরতাল প্রত্যাহার