ঢুকছে না কিছুতেই মাথায় বিষয়টি! হল এমন, কী করে? অবশ্য শুনেছি অনেকবারই যে, সৌদিতে জিপিএস প্রায়শই উল্টাপাল্টা পথনির্দেশ করে পথিককে, না পথিককে তো না গাড়ীচালককে যায় নিয়ে ভুল পথে! এ কারণেই লাগাবো লাগাবো করে এখনো লাগাইনি জিপিএস নিজ গাড়িতে। আবার এজন্যই তো নিয়েছিলাম ধার, আমিন ইব্রাহিমের প্রাডোটি। কিন্তু তাতেও তো হল না শেষ রক্ষা!
ভাবিতেছি এক্ষণে তাই, আহা আজিকে এ যদি হইতো ঘন বন কোন, তাহা হইলে নিজে নবকুমার না হইলেও কোন না কোন কপালকুন্ডলা এই অধমকে হয়তো আসিয়া জিজ্ঞাসিত, “পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো?”
কিন্তু বনের বদলে জিপিএসের গড়বড়ে অবশেষে সখাত সলিলে তো নয় পড়েছি এক্কেবারে আদিগন্ত বালির সাগরে। জনবসতির চিহ্নমাত্র নাই কোন যে, কোন মরুকপালকুন্ডলা আসিয়া এ অধম পথ হারিয়েছে কী না জিজ্ঞাসিবে। অবশ্য যদি তা হয়ও, তাতেই বা কী? বুঝি না তো আরবি।
কপাল ভাল যে নিজের সিডানটি নিয়ে রওয়ানা করিনি, মরুমধ্যকার আর্কেডিয়া দিরাব গ্লফ কোর্স ও কাউন্ট্রি ক্লাবের উদ্দেশ্যে। নিয়েছিলাম ধার আমিনের ফোর হুইল ড্রাইভ প্রাডোটি। না হয় বালির সাগরে তো পেরুতে পারতাম না।
অবশ্য এখনও যে পারবো তা, সেটাই বা বলি কিভাবে? জিপিএসের কুমন্ত্রণায়, আবু দিরাবের দিকে যাওয়ার মরুমধ্যকার চমৎকার যাকে বলে তেলের মতো মসৃণ পিচঢালা পথ, সেটি ছেড়ে কখন যে কোন কুহকে পড়ে, দিয়েছিলাম ঝাঁপ এই বালুর সায়রে, তাও তো মনে করতে পারছি না! তবে দিককানা আমি যখনই তা খেয়াল করেছি, আন্দাজে সামনে বা ডানে বা বাঁয়ে এগুনো বাদ গিয়েছিলাম থেমে তখনই। এখন আবু দিরাবের পথ যদি খুঁজেও না পাই, তাতে সমস্যা কিছু না হলেও, বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে না পেলে হবেটা কী? একথা মনে হতেই পূর্ণশক্তিতে চলা গাড়ির এসির হাওয়ায় বসে থেকেও এক্কেবারে ঘেমে যাওয়ার যোগাড় হল !
নাহ গাড়ীর মধ্যে বসে থেকে ঘাবড়ে গেলে তো চলবে না। খেলাতে হবে মাথা! সে জন্য বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেবার নিমিত্তে, গাড়ী থেকে বেরিয়ে দুপুরের মরুসূর্যের গনগনে হল্কায় মুড়িভাজা বালির মতো তেতে উঠা বালিতে নেমে সিগারেট ধরাতেই পড়ল চোখে, দৃশ্যটা!
বেশ আগে দেখেছিলাম “লরেন্স অব এরাবিয়া”। সেই ছবিতে দেখা, কালো পোষাক পরা, মাথার পাগড়ির লেজে মুখ ঢেকে রাখা কয়েকজনকে দেখছি দুরন্ত গতির ঘোড়ার খুড়ে বালি উড়িয়ে, নিজেদের হাতের অস্র উঁচিয়ে আসছে এদিকেই।
যাক, কপাল ভাল যে এদের দেখা পেলাম! হাত পা নাড়িয়ে কথা বলে, হদিস নেয়া যাবে পথের। এই ভাবনায় আয়েশ করে সিগারেটে জোর টান দিতে দিতে নিজেকে লরেন্স লরেন্স মনে হচ্ছিল যখন
তখনই মরুবেদুইনদের ঐ দলটির সর্দারটিকে চিৎকার করে কিছু একটা বলতে বলতে দুরন্ত গতিতে ছুটন্ত তার ঘোড়াটি যাতে আমাকে শুইয়ে দিয়ে হুমড়ি খেয়ে না পড়ে আমিনের প্রাডোতে, সে চেষ্টায় প্রাণপণে লাগাম টেনে ধরতে দেখায়, নিজেও এক লাফে ডান দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই, আমার লরেন্সগিরি ছুটে গিয়ে অকস্মাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ার উপক্রম হতেই, ইজ্জত বাঁচানোর তুমুল চেষ্টায় সে পতন ঠেকাতে ঠেকাতে আবিস্কার করি, আছি নিজ বিছানায়!
তা এ যদি আমার বিছানাই হবে, এতো গরম লাগছে কেন? ঘেমেই বা গেলাম কেন? বরাবর ২০/২২ ডিগ্রিতে চালিয়ে রাখা এসির কারণে প্রায়শইতো ঘুমের মধ্যেই গায়ে টেনে নেই, দেশ থেকে নিয়ে আসা বহুকাল আগে আম্মার হাতে সেলাই করা কাঁথা। কাঁথা গায়ে টেনে নেবার মতো হিমের বদলে গরম কেন হয়ে উঠেছে রুমটা?
তুমুল আলস্যে চোখ মেলে ডানের জানালার উপরে তাকিয়ে দেখি, জ্বলছে না এ সির সবুজ লাইট। নির্ঘাত বিগড়েছে এসিটি। হায়রে, অবস্থা তো দেখি হয়েছে আমার; অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়! সকাল ৯/১০ টার আগে তো কমপাউন্ডের মেইনট্যানেন্সের লোকদের পাওয়া যাবে না। ভাবতে ভাবতে বিছানা ছেড়ে, বসার ঘরের এসি চালিয়ে সোফায় বসে সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে ভাবছি, রিয়াদ এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন সেদিন আমার দুবাই যাওয়া ঠেকিয়ে দেয়ার পর, এমিরেটসের অফলোড করে দেয়া ব্যাগ সুটকেস নিয়ে রিয়াদ শহরের নিজ ঠিকানায় ফেরার পর গত চারদিন আক্ষরিক অর্থেই করছি স্বেচ্ছাহাজতবাস। হ্যাঁ ভুলেও এই কমপাউন্ডের চৌহদ্দি পেরিয়ে যাই নি বাইরে। সেদিন সৌদি এয়ারলাইন্স দুবাইগামী আমিরা ও আয়শাকে, মাহরাম না থাকার কারণে তাদেরকে চেক ইন করেনি, তাই তাদেরও ফিরে আসতে হয়েছিল জানি। কিন্তু এমিরেটসে আমার চেক ইন হয়ে যাবার পর, ইমিগ্রেশন কেন যে আমাকে যেতে দিল না, জানি না তা এখনো! কারণ সেসময় এ ধরনের যন্ত্রণার সম্ভাব্য মুশকিল আসান গিউসিকে ফোন করে তিনজনের এই দুর্গতি জানানোর পর, দুবাই থেকে সে রিয়াদ এয়ারপোর্টের তার নানান পরিচিতজনকে ফোন করেও সুরাহা করতে পারেনি কিছুই!
ফলে ট্যাঙি ধরে কমপাউন্ডে ফিরতে ফিরতে জানিয়েছিলাম ঘটনা ফোনে, জিয়াকে। আমার বিবরণ শুনে, প্রথমেই জিয়া পরামর্শ দিয়েছিল যে, ভিসার মেয়াদ যেহেতু আমার ঐ দিনই শেষ হয়েছে, আমি যেন ওটা অফিসিয়ালি ঠিক না করা পর্যন্ত কমপাউন্ড ছেড়ে বের না হই। কেননা এমতাবস্থায় টহল পুলিশের পাল্লায় পড়লে তাদের চোখে এ মিসকিনের খবর হয়ে যাবে। অতোটা গুরুত্ব না দিয়ে হলেও, গিউসির পরামর্শও ছিল অভিন্ন!
এরপর সে সন্ধ্যাতেই জিয়া অফিস শেষে, আমার ঘরে রান্নাবান্না করে খাওয়ার মতো কাঁচাবাজার নাই মনে করে সে সব এক গাদা কিনে হাজির হওয়ার পর, আড্ডা মারতে মারতে এমন এক কাহিনী শুনিয়েছিল, তাতে যতো না নিজের জন্য ভয় পেয়েছিলাম, তারচেয়ে হয়েছিলাম এমনই মর্মাহত যে বেশ কিছুক্ষণ ছিলাম বাকরুদ্ধ!
জিয়ার ভাষ্যমতে, শুনেছে সে বছর কয়েক আগে, রিয়াদে সস্ত্রীক বসবাসকারী এক বাংলাদেশী তরুণের সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে, গর্ভকালীন কোন জটিলতার কারনে কোন একটা হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। তাতে চিকিৎসক ও নার্সদের আপ্রাণ চেষ্টায় নবজাতকটি ঠিকঠাক মতোই এই গ্রহের আলোর মুখ দেখলেও, জীবন সংশয় হয়ে পড়েছিল মায়ের। ফলে স্থান হয়েছিল মা’য়ের আই সি ইউর নিবিড় পরিচর্যায়। এমতাবস্থায় বাচ্চাটি, বাচ্চাদের ওয়ার্ডে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হেফাজতে এক কী দু’দিন থাকার পর, এবং বাস্তাটি একদম সুস্থ সবল হওয়ায়, তার বাবা হাসপাতালের বিল বাড়ার হাঙ্গামা এড়ানোর জন্য বাচ্চাটিকে নিজ দায়িত্বে বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। বাসায় নিয়ে আসার পর পরই, পড়েছিল মনে বাবাটির যে বাচ্চাকে খাওয়ানোর মতো দুধ, ফিডার এসব তো ঘরে নাই! এদিকে ঘরে অন্য কোন লোকজনও নাই, যে বাচ্চাটিকে দেখাশোনা করতে পারে। কিন্তু তার তো ঐ সব কিনে আনাও দরকার দ্রুত!
এমতাবস্থায় মরিয়া হয়ে বাবাটি বেশ কিছুক্ষন প্রতিবেশীর দরজা ধাকাধাক্কি করে যখন বুঝলেন যে ঐ মুহূর্তে ঐ ঘরও খালি, ভেবেছিলেন দোকান তো বেশি দুরে না। ওখান থেকে বাচ্চার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র নিয়ে ফিরতে খুব জোর মিনিট দশেক লাগবে। বাচ্চা যেহেতু ঘুমাচ্ছে এই ফাঁকে উনি দোকান থেকে ঐসব নিয়ে আসতে পারবেন।
এই ভেবে তড়িঘড়ি করে রাস্তায় নামার কিছুক্ষণের মধ্যে যখন মনে পড়লো তার যে ভুলে ঘরে মানিব্যাগ ফেলে এসেছেন, তাতেও তিনি বাসায় না ফিরে দোকানের দিকেই এগুচ্ছিলেন দৌড়ের জোর বাড়িয়ে। কারণ পরিচিত সেই দোকানে দুয়েকবারতো বাকিতেও সওদা করেছেন উনি। এ নিয়ে সমস্যা তো নাই কোন!
কপালের ফেরে সে সময় ঐ এলাকা দিয়ে গাড়ী নিয়ে যেতে থাকা টহল পুলিশের, ধাবমান ঐ বাবাটির দিকে চোখ যেতেই, তাকে থামার জন্য জোর হুকুম জারী করে কেন সে দৌড়াচ্ছে এ ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করলে সাধ্যমতো জানা আরবিতে সে পুলিশদের তা ব্যাখ্যা করলে, মনপুত হয় না তা তাদের মোটেও। উল্টা তখন তারা, সে যে বৈধ ভাবে আছে সৌদিতে সেটির প্রমান হিসেবে দেখতে চায় ইকামা। হায়! ঐ সবই তো ছিল ঘরে! ফলে বেচারা ব্যাপারটা প্রাণপণে পুলিশকে বুঝিয়ে, অনুনয় করে যাতে তাকে বাসায় যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। এমনকি অনুনয় করলেন পুলিশরাও যেন যায় তার বাসায়। তাহলেই উনি ইকামা দেখাতে পারবেন। তাতে একই সাথে পুলিশেরাও দেখতে পাবেন যে, আসলেই দুই তিন দিন বয়সী বাচ্চাটি যে তার ঘরে একা আছে।
কিন্তু নাহ! সকল সকাতর অনুনয়, বিনয়, কান্নাকাটি তুমুল অবজ্ঞায় উপেক্ষা করে পুলিশ জোর করে তাকে তুলে নেয় গাড়িতে। মিসকিন বাংলাকে তো মোটেও বিশ্বাস করে না সৌদি পুলিশ!
গাড়িতে তোলার পর নিরুপায় ও হতভাগ্য ঐ পিতা, চিৎকার, চেঁচামেচি করার সাথে হাত পা ছুঁড়ে দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে যেতে চাইলে, পুলিশ মেরে তাকে অচেতন করে নিয়ে পুরে দেয় হাজতে।
হাজতের মেঝেতে বাবাটি অচেতন পড়ে থেকে সন্ধ্যার দিকে তার জ্ঞান ফিরলে, ফের কান্নাকাটি থেকে শুরু করে চিৎকার চেচামেচি করে পুলিশের কাছে নিজের ফোনটি ফেরত চান উনি, যাতে দ্রুত বাচ্চাটিকে উদ্ধার করা যায় পরিচিতজনদের মাধ্যমে। কিন্তু তাতেও থানাওয়ালার মন গলছে না দেখে, বেচারা ফের উদভ্রান্তের মতো আচরণ শুরু করলে, পুলিশ ফের তাকে মেরে অচেতন করে ফেলে। এভাবে দুই কি তিন দিন অমানুষিক মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের পর, এক পুলিশ কোন এক অজানা কারণে দয়াপরবশ হয়ে, তাকে তার ফোনটি কিছুক্ষণের জন্য এনে দিলে, লোকটি তার কফিল ও পরিচিতজনদের জানানোর পর, তাদের চেষ্টায় ছাড়া পেলেও, যা হওয়ার তো হয়েই গেছে ততক্ষণে! হুম, এটুকু শোনার পরই, জিয়াকে কাহিনীটির অনিবার্য ভয়াবহ পরিণতির দিকে আর এগুতে দেইনি।
এমনকি সেই কাহিনী এখন ফের মনে পড়তেই আবারো গা কাঁটা দিয়ে ওঠার সাথে, মনের আকাশ তো গেল ঢেকে মিশকালো ঘন মেঘে। আহারে বাচ্চা! মায়ের জীবন আশংকা তৈরি করে নিজে তুই সুস্থ জন্মেও, শেষ পর্যন্ত আর থাকা হল না তোর এ গ্রহে! নিতে হল বিদায় তোর নিদারুণ কষ্টে ধুঁকে ধুঁকে! বাংলামায়ের বাচ্চা, কোন ভুলে যে তুই মাতৃজঠর ছেড়ে নানি দাদীর কোলে উঠার বদলে এসেছিলি এইখানে, যেখানে একদা আইয়ামে জাহেলিয়াত বিরাজ করতো বলে পড়েছিলাম যেমন বইয়ে, শুনি তেমনি এখনো তা হুজুরদের ওয়াজে বয়ানে!
আচ্ছা, ঐ মা টি কি ফিরতে পেরেছিল আই সি ইউ থেকে? ঐ হতভাগিনী যদি ফিরেও থাকেন, তবে উনি ও ওনার হতভাগ্য স্বামী কি অবেশেষে থেকে গিয়েছিলেন এই দেশে? আছেন কী এখনো? নাহ, কিছু ভাবতে চাই, এ নিয়ে আর। এ এমন এক কাহিনী, মনেও রাখতে চাই না তা। যদি পারতাম মুছে দিতাম ওটা সেদিন তক্ষুণি মগজের নিউরন থেকে, শুনেছিলাম যখন তা। কিন্তু তা পারিনি বলেই এইরাতে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে এরই মধ্যে বেশ ঠাণ্ডা হয়ে উঠা বসার ঘরেও মনে হচ্ছে ঘামতে শুরু করছি। ইস! ডিলিট বাটন টিপে কম্পিউটারের মগজ থেকে যেরকম তথ্য, ডাটা মুছে দেয়া যায়, মানুষ যদি তার নিজ মগজ থেকে ঐভাবে যাপিত জীবনের ভয়াবহ সব তথ্য, গল্প, স্মৃতি মুছে দিতে পারতো তবে হয়তো জীবনানন্দের সেই “আরো এক বিপন্ন বিস্ময়ের” মুখোমুখি হতে হতো না কারো! লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।