দৈনিক আজাদী সম্পাদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক এম এ মালেককে ‘সমাজের পথ চলার প্রতীক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে একুশে পদকপ্রাপ্ত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব কবি আবুল মোমেন বলেছেন, এম এ মালেক এই শহরের মর্যাদার প্রতীক, ভালোবাসার প্রতীক। প্রতিটি শহরে এই ধরনের কিছু কালারফুল মানুষ থাকেন, যারা শহরকে প্রতিনিধিত্ব করেন। এম এ মালেক তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজেকে চট্টগ্রামের আইকনিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছেন। তিনি আমাদের সমাজের অগ্রযাত্রার প্রতীক, পরিশ্রমী মানুষের প্রতীক, সফল মানুষের প্রতীক। তিনি নিজেকে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছেন।
গতকাল শনিবার দুপুরে নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের কর্ম ও জীবন নিয়ে প্রকাশিত ‘এম এ মালেক : ঋদ্ধ জীবনের রূপকার’ শীর্ষক প্রকাশিত গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। কবি ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন বলেন, আমাদের সমাজে এক ধরনের অপূর্ণতা বিরাজ করে। কেউ সূচনা করলে আর শেষ করে না। কেউ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলে পরে এসে পাল্টে যায়। বিশেষ করে রাজনীতিতে। কিন্তু এম এ মালেক একজন পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজেকে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন।
তিনি বলেন, আজকে যে অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়েছে সেটিকে বলা যেতে পারে শত রূপে শতভাগ। মালেক ভাইকে নিয়ে এই যে উপস্থাপনা তা আমরা দেখছি। সঙ্গে ভাবীও আছেন। বাংলাদেশের নানা ক্ষেত্রের বিশিষ্ট মানুষজন সেখানে উপস্থিত আছেন। অর্থাৎ তিনি যে জীবনটা কাটিয়েছেন সেটি একটি বর্ণাঢ্য জীবন, চলমান জীবন। এটি একটি ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা।
কবি আবুল মোমেন বলেন, আমরা সবাই জানি যে উনার পিতা মরহুম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার দৈনিক আজাদী পত্রিকাটি শুরু করেছিলেন। তখন মালেক ভাই তরুণ, কমার্স কলেজের ছাত্র। সেই তখন থেকে গত সাত দশক ধরে পত্রিকাটা ধারাবাহিকভাবে চলছে। এটি সাত দশকের পত্রিকা। পিতার মৃত্যুর পরে এম এ মালেক এটির দায়িত্ব নিয়েছেন। তার সঙ্গে ছিলেন তার ভগ্নিপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। দৈনিক আজাদীকে তিন প্রজন্মের পত্রিকা আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এখন আমাদেরকে চতুর্থ প্রজন্মের জন্য তৈরি হতে হবে। আমরা চাই সেটি যেন ঠিকভাবে হতে পারে। কারণ বাংলাদেশ অঞ্চলে আমরা কিন্তু কোনো হাউস দীর্ঘস্থায়ী করতে পারি না। সেই দিক থেকে দৈনিক আজাদী একটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা দেখছি পত্রিকাটির এখন সপ্তম দশক চলছে এবং এটি একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে।
সংবাদপত্রের আগেকার দিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, দৈনিক আজাদী যখন প্রকাশিত হয়েছে তখন নিউজপেপার এক ধরনের ঘরোয়া প্রতিষ্ঠান বা হাউসহোল্ড এন্টারপ্রাইজ ছিল। ছিল কুটির শিল্প। এটাকে বড় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে আসা হয় আশির দশকে। এম এ মালেক সফলভাবে দৈনিক আজাদীকে সেই শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন বলেই দৈনিক আজাদীর সাত দশকের গৌরবময় পথ চলা অব্যাহত রয়েছে।
দৈনিক আজাদীর পারিবারিক হিতৈষীবৃন্দের আয়োজনে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, ১৯৬০ সালে আজাদী কাগজটা বের করার দুই বছর পর বাবা মারা যান। তারপর আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল। সেই সময় কাগজ চালানো অনেক কষ্টকর ছিল। যদি আমি সেদিন ছেড়ে দিতাম তাহলে মানুষ বলতেন ইঞ্জিনিয়ার খালেক সাহেবের ছেলে চালাতে পারেনি। বাবার অযোগ্য ছেলে হিসাবে পরিচিত হতাম। তাই এটাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছি; কাগজটাকে বাঁচিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ। আমার মনে হয় না অবিভক্ত বাংলায় মফস্বলের কোনো পত্রিকা এত বছর বেঁচে আছে। দৈনিক আজাদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে নিজের পরিবারের সদস্য ভাবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবাই যদি মনে করে কাগজটা আমার তাহলে অনেক কাজই সহজ হয়ে যায়। আজাদী পরিবারের সবাই দৈনিক আজাদীকে নিজের পত্রিকা মনে করে বলেই সেটি এভাবে মাথা উঁচু করে টিকে রয়েছে। দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, সাবেক বার্তা সম্পাদক সাধন কুমার ধর, বিমলেন্দু বড়ুয়াসহ প্রয়াত সহকর্মীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, উনারা দৈনিক আজাদীকে এগিয়ে দিয়েছিলেন বলেই সেটি এতদূর আসতে পেরেছে।
আজাদী সম্পাদক বলেন, বাবার রেখে যাওয়া পত্রিকাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি বলে বিবিসি বাংলাকে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় বলেছিলাম আমি আমার স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছি। স্বপ্ন ছোঁয়া একটি দুরূহ ব্যাপার। আমি আমার সাধ্যের বাইরে যা চাইব আমি সেটুকুই গরিব। নিজের সাধ্যের মধ্যে প্রত্যাশা থাকলে মানুষ কখনো গরিব হতে পারে না। আমি আমার যা ছিল তা নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছি। এটাই আমার জীবনের মূলমন্ত্র বলে মনে করি। এখানে আমার সম্পর্কে যতটুকু বলা হচ্ছিল আসলে আমি এটাতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। আসলে আমি এতটুকু না। আপনারা আমাকে ভালোবাসেন বলেই আমার সম্পর্কে এত মূল্যবান সুন্দর সুন্দর কথাগুলো বলেছেন। এটা হচ্ছে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আমি কতটুকু পেরেছি জানি না। তবে চেষ্টা করেছি। মানুষ চেষ্টা করলে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। এই যে ক্যানসার হসপিটাল, মা ও শিশু হাসপাতাল, সেখানে চেষ্টা করেছি। আজ সেখানে একটি হসপিটাল হয়ে গেছে। যাদের ক্যানসার হয় তারা নিজেরাও মরে, পরিবারকেও মেরে যায়। আমরা ওই হাসপাতালটিকে আরো সমৃদ্ধ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চাই। তাহলে যারা ক্যানসার রোগী আছে তারা বেশি উপকৃত হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পিতার নামে বৃত্তি চালুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে দুইটা স্কলারশিপ আছে জার্নালিজমে আর ৮টা হচ্ছে আর্টস ফ্যাকাল্টির জন্য। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই বৃত্তি প্রদান করে। নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করেন বলে উল্লেখ করেন আজাদী সম্পাদক।
অনুষ্ঠানে লায়ন্স জেলার সাবেক গভর্নর লায়ন কামরুন মালেক বলেন, আমাদেরকে যেভাবে সম্মানিত করা হলো এটি আমরা কোনোদিন ভাবিনি। এই সম্মানে আমরা আপ্লুত। আমরা শুধু আপনাদের দোয়া চাই। আমার ছেলেরা যেন তাদের বাবার মতো সততার সাথে জীবন ধারণ করতে পারে, তাদের বাবার মতো হয়, সেই দোয়া চাই।
বিসিবি পরিচালক লায়ন এম মনজুর আলম মঞ্জু বলেন, অবহেলিত চট্টলার ভাগ্যোন্নয়নে, সমাজ পরিবর্তনে, রাষ্ট্র কাঠামো গঠনে লায়ন এম এ মালেক লক্ষ লক্ষ যুবকের অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি অত্যন্ত মানবিক একজন মানুষ। মানুষের জন্য, সমাজের জন্য তিনি নিরন্তর কাজ করে গেছেন। এই ৮৫ বছর বয়সেও তিনি সমাজের জন্য, মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করেন। তার প্রতিটি পদক্ষেপই এঁকে দিয়েছে তার সাফল্যের পদচিহ্ন।
দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক বলেন, কিভাবে বিনয়ী হতে হয় তা আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি। চেষ্টা করি বাবার মতো হতে। দৈনিক আজাদীর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে নিজের পরিবারের সদস্য মনে করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, সকলকে নিয়ে সুন্দর করে চলার শিক্ষাও বাবার কাছে পেয়েছি। আমরা ছোট একটা শহরে থাকি। সবাইকে নিয়ে সুন্দর থাকাটাই আমাদের উদ্দেশ্য। আমরা যেন সামনের দিনগুলোতেও বাবার মতো চলতে পারি, দৈনিক আজাদীকে আরো অনেক দূর নিয়ে যেতে পারি, সবার কাছে সেই দোয়া চাই।
দৈনিক আজাদীর সহযোগী সম্পাদক কবি রাশেদ রউফের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন লায়ন মোহাম্মদ ইমরান, দৈনিক আজাদীর নির্বাহী সম্পাদক পারিহা মালেক ও শিহাব মালেক, দ্য এডের স্বত্বাধিকারী শিল্পী দীপক দত্ত, নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজি, দৈনিক আজাদীর বার্তা সম্পাদক দিবাকর ঘোষ, চিফ রিপোর্টার হাসান আকবর, সিনিয়র সহসম্পাদক রেজাউল করিম ও সিনিয়র সহসম্পাদক জসীম উদ্দীন সিদ্দিকী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন গ্রন্থটির সম্পাদক ও দৈনিক আজাদীর ফটো সাংবাদিক সোহেল রানা।