উন্নত বিশ্বের দেখানো পথে খাদ্যে সেলেনিয়াম ন্যানো পার্টিকেল ব্যবহার করে অবশেষে কোরাল চাষে সাফল্য পেয়েছেন বাংলাদেশের মৎস্য বিজ্ঞানীরা। কক্সবাজারের কলাতলী ও খুরুশকুলে দীর্ঘদিন গবেষণার পর সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এই সাফল্য পান। এর ফলে কক্সবাজারসহ দেশের উপকূলীয় এলাকার মৎস্য ঘেরে কোরাল মাছ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে বিজ্ঞানীদের অর্জিত এই প্রযুক্তিতে কোরাল মাছ চাষের জন্য চাষিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে মৎস্য বিভাগ। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র মিলনায়তনে আয়োজিত এক কর্মশালায় দেশের ৫০ জন মৎস্য চাষিকে নতুন প্রযুক্তিতে কোরাল চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
‘সেলেনিয়াম ন্যানো পার্টিকেল সম্পূরক খাদ্যের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক মাছ এশিয়ান সি–বাস এর ব্রুডস্টক উন্নয়ন’ শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মশালাটিতে সভাপতিত্ব করেন কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও সাস্টেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট (এসসিএমএফপি) এর প্রকল্প পরিচালক মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী, বিশেষ অতিথি ছিলেন মৎস্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন, কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান এবং এসসিএমএফপি প্রকল্পের উপ–প্রকল্প পরিচালক মো. মিজানুর রহমান।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ও সুনীল অর্থনীতি উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর ‘সাস্টেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’ অর্থায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় চাষিদের হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, যাতে তারা উদ্ভাবনী চাষ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন। একই সঙ্গে একাধিক এমএস শিক্ষার্থী এই প্রকল্পের অধীনে তাদের থিসিস গবেষণা সম্পন্ন করেছেন, যা একাডেমিক ও শিল্পখাতের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতা সৃষ্টি করেছে। কর্মশালা শেষে মূল আলোচনা পর্বে অংশগ্রহণকারীরা সেলেনিয়াম ন্যানো পার্টিকেল–ভিত্তিক ব্রুডস্টক খাদ্য সম্প্রসারণ, সামুদ্রিক মাছের বীজ উৎপাদন জোরদারকরণ এবং উপকূলীয় চাষিদের সক্ষমতা বৃদ্ধির কৌশল নিয়ে মতবিনিময় করেন। এই উদ্ভাবন বাংলাদেশের জলবায়ু–সহনশীল ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই সামুদ্রিক মৎস্য উন্নয়নের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি ও জেনেটিক্স বিভাগের প্রফেসর ড. এ কে শাকুর আহাম্মদ, সহ–গবেষক ও একুয়াকালচার বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহফুজুল হক কর্মশালায় প্রকল্পের ফলাফল উপস্থাপন করেন। এছাড়া এ প্রকল্পে সহ গবেষক ছিলেন কলাতলীস্থ গ্রিন হাউস মেরিকালচারের পরামর্শক তরিকুল ইসলাম চৌধুরী এবং গবেষণা সহকারী ছিলেন আবু বকর, শাহনুর জাহেদুর রহমান সানী ও মো. ইলিয়াছ আহমদ।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি ও জেনেটিক্স বিভাগের প্রফেসর ড. এ কে শাকুর আহাম্মদ জানান, সেলেনিয়াম ন্যানো পার্টিকেল সম্পূরক খাদ্য কোরাল মাছের বৃদ্ধি, প্রজনন গ্রন্থির স্বাস্থ্য ও গোনাডাল কার্যক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। কক্সবাজারের কলাতলী ও খুরুশকুলে দীর্ঘদিন গবেষণার পর সম্প্রতি তারা এই সাফল্য পেয়েছেন। তিনি জানান, কলাতলীস্থ গ্রিনহাউস মেরিকালচার হ্যাচারিতে ট্যাঙ্কভিত্তিক রিসার্কুলেটিং একুয়াকালচার সিস্টেম বা আরএএস পদ্ধতিতে এবং খুরুশকুলে কেস কালচার বা খাঁচা পদ্ধতিতে এই গবেষণা করা হয়। এর মধ্যে ট্যাঙ্কভিত্তিক রিসার্কুলেটিং একুয়াকালচার সিস্টেমে খাঁচাভিত্তিক চাষের তুলনায় প্রায় শতকরা প্রায় ৬০% ভাগ বেশি বৃদ্ধি ও ৫০% কম ফিড কনভার্শন রেশিও (এফসিআর) প্রদর্শন করেছে। এছাড়া সেলেনিয়াম ন্যানো পার্টিকেল প্রয়োগকৃত মাছে প্রারম্ভিক ডিমের গোনাডাল পরিপক্বতা ও উচ্চতর গোনাডোসোমাটিক ইনডেক্স (জিএসআই) দেখা যায়, যা হিস্টোলজিক্যাল ও জিএএমএম পরিসংখ্যানগত মডেলিং দ্বারা নিশ্চিত হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা জানান, সেলেনিয়াম ন্যানো পার্টিকেল হল প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া সেলেনিয়াম নামের অধাতব মৌলের ন্যানো–আকারের কণা; যা তাদের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যান্সার প্রতিরোধী, প্রদাহ–বিরোধী এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল গুণের কারণে জৈব–ঔষধে ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পুষ্টির দিক থেকে এটি একটি অপরিহার্য উপাদান।
এক মিলি মিটারের দশ লক্ষ ভাগের একভাগ বা এক মিটারের একশ কোটি ভাগের একভাগ অংশকে এক ন্যানো মিটার বলা হয়। আর ন্যানো পার্টিকেলগুলির আকার সাধারণত ১ ন্যানো মিটার থেকে ১০০ ন্যানো মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই আকার এত ছোট যে এগুলি অনন্য ভৌত এবং রাসায়নিক গুণ প্রদর্শন করে। এর ফলে এগুলিকে বিভিন্ন প্রযুক্তিতে ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তোলে।
গবেষকদল আরও জানায়, সোডিয়াম সেলেনাইটের জলীয় দ্রবণকে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড দিয়ে রিডিউস করে নিয়ন্ত্রিত pH ও তাপমাত্রায় সেলেনিয়াম ন্যানোপার্টিকেল (SeNP) প্রস্তুত করা যায়। প্রটোকলটি তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়সাপেক্ষ এবং ল্যাব থেকে মাঠপর্যায়ে স্কেল-আপের জন্য উপযোগী; তবে ফিড-গ্রেড ব্যবহারের আগে কণার আকার-বিতরণ ও অবশিষ্ট সেলেনিয়ামের মাত্রাসহ প্রয়োজনীয় মাননিয়ন্ত্রণ যাচাই করা জরুরি।