দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো–অর্ডিনেশন সেলের (ডব্লিউটিসি) কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি তদন্ত না করা, নেতারা নানা কৌশলে বিপুল অর্থ বছরের পর বছর ধরে আটকে রাখাসহ দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ তুলে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে পাঠানো একটি চিঠি নিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সেক্টরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে সংস্থাটির নাম বিডব্লিউটিসি। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মেজর (অব.) জি এম খান গতকাল এই চিঠি প্রেরণ করেন। এতে লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের নেতা গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু, জিএম সারোয়ার, তৌহিদুল আনোয়ার ও জাহাঙ্গীর আলম দোভাষের কাছে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বছরের পর বছর আটকে থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। ব্যক্তিগত ঋণের বাইরে গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠুর কাছে আলোচিত শেলটেক জাহাজের ১৫ লাখ টাকা গত দশ বছর ধরে আটকে থাকার তথ্য তুলে ধরা হয়। কোয়াব চেয়ারম্যান এবং বিসিভোয়ার সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবিরের নেতৃত্বে ডব্লিউটিসিতে সংগঠিত বিভিন্ন দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও বিগত এক বছরে কমিটি কোনোরূপ তদন্ত না করে রহস্যজনক ভূমিকায় থাকা নিয়েও চিঠিতে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। বিষয়গুলো বিস্তারিত উপস্থাপন করে সংস্থার আটকে পড়া টাকা উদ্ধারে নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালকের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।
বিডব্লিউটিসির নির্বাহী পরিচালক মেজর (অব.) জি এম খান প্রেরিত গোপনীয় চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০০৪–২০০৫ সালে জন্মলগ্ন হতে নভেম্বর ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২০ বছর ধরে ডব্লিউটিসি নৌ পথে পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত থাকে। এই দীর্ঘ সময়ে ডব্লিউটিসির সার্বিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেন বিসিভোয়া, কোয়াব ও আইভোয়াকের নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ। উল্লেখিত সময়ে ডব্লিউটিসির কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে বটে, কিন্তু সার্বিক কোনো প্রশাসনিক নির্দেশনা পূর্বেও ছিল না, এখনো নেই। বিভিন্ন প্রকার আর্থিক অনিয়ম ও অভিযোগের প্রেক্ষিতে আইভোয়াক ডব্লিউটিসির সঙ্গে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে। ফলে ডিসেম্বর ২০২৩ হতে ডব্লিউটিসির অপারেশনাল কার্যক্রম পুরাপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ডব্লিউটিসির সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকা অবস্থায় প্রায় ১০ মাস পর ২০২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ডব্লিউটিসির নির্বাহী পরিষদের ৪৬তম সভা (শেষ সভা) অনুষ্ঠিত হয়। সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাঈদ আহমেদ ডব্লিউটিসির কনভেনর নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর হতে বিডব্লিউটিসির কার্যক্রম শুরু হয়।
চিঠিতে বলা হয়, ডব্লিউটিসি নির্বাহী পরিষদের ৪৬তম সভায় ২০০৪–২০০৫ সাল হতে ২০২৩ সাল অবধি সময়কালে সংগঠিত বিভিন্ন প্রকার আর্থিক অনিয়ম উদঘাটনের লক্ষ্যে বিসিভোয়ার সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবিরকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। হতাশার বিষয় এই যে, কমিটি গঠনের পর হতে অদ্যাবধি ১ বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির উক্ত তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেননি। তিনি কমিটি থেকে পদত্যাগও করেননি। একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম তদন্তের লক্ষ্যে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রধানের এরূপ নিষ্ক্রিয়তা সেক্টরের সকল মহলে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।
চিঠিতে আরো বলা হয়, বিসিভোয়ার নির্বাহী পরিষদের নির্বাচনের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। এই নির্বাচন সম্পন্ন হলে বিসিভোয়ার বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির স্বপদে থাকবেন না এবং আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি নির্বাচনে অংশ গ্রহণও করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে কথিত তদন্ত সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করা যথার্থ হবে। উল্লেখ্য, বর্তমান তদন্ত কমিটির সকল সদস্য পূর্বে কোনো না কোনো সময়ে ডব্লিউটিসির নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। তাই স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি পুনঃগঠিত হলে সামগ্রিকভাবে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
আলোচিত তদন্ত কমিটির উদঘাটিত তথ্যাবলি, মতামত, সুপারিশ এবং তৎপরবর্তী কোনো সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় বিসিভোয়া এবং আইভোয়াক সংগঠন দুটির কয়েকজন সদস্যের কাছে লোন বাবদ নেয়া অর্থ আদায়ের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে বিসিভোয়ার গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু নিমজ্জিত জাহাজ উদ্ধারের নামে ২৫ লাখ টাকা, লোন হিসেবে ২৪ লাখ ৫৭ হাজার ৯৯৯ টাকা ২০১৫ সাল থেকে আটকে রেখেছেন। এর বাইরে একই সময়ে শেলটেক জাহাজ বাবদও ১৫ লাখ টাকা তিনি দশ বছর ধরে আটকে রেখেছেন। এছাড়া বিসিভোয়ার জি এম সারোয়ার ব্যক্তিগত লোন হিসেবে ৫০ লাখ টাকা ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে, আইভোয়াকের তৌহিদুল আনোয়ার ব্যক্তিগত লোন হিসেবে ১০ লাখ টাকা, আইভোয়াকের জাহাঙ্গীর আলম দোভাষ ব্যক্তিগত লোন হিসেবে ১০ লাখ টাকা ২০২৩ সাল থেকে আটকে রেখেছেন। চারজন নেতার কাছে আটকে থাকা ১ কোটি ১৯ লাখ ৫৭ হাজার ৯৯৯ টাকা উদ্ধারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করে টাকাগুলো উদ্ধারে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।
এছাড়া দৈনন্দিন এবং রুটিন খরচের বাইরে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় খাত যেমন সাধারণ উপহার, ঈদ উপহার, বখশিস, অনুদান খাতে ২০১৯–২০২৩ এ ৫ বছরে ১৪ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। অপ্রয়োজনীয় এসব খাতে অর্থ খরচের ক্ষেত্রে ডব্লিউটিসির নির্বাহী পরিষদে আলোচনা বা অনুমোদন হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়। টাকার প্রয়োজন হলে নোটশিট করে টাকা তোলা হয়েছে। তৎকালীন ডব্লিউটিসির আর্থিক অনিয়মের বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং যথাবিহিত প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বর্তমান বিডব্লিউটিসিতেও একইভাবে আর্থিক খরচে অনিয়মের চর্চা হবে উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
একাধিক জাহাজ মালিক গতকাল আজাদীকে বলেন, ২০০৩ সালে জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন লাইটারেজ ঠিকাদার সমিতিকে সাথে নিয়ে জাহাজের সিরিয়াল প্রথা চালু করে। কিছুদিন যাওয়ার পর ঠিকাদার সমিতিকে বের করে নিজেরা কোঅর্ডিনেশন সেল গঠন করে। এর কিছুদিন পরে চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের সংগঠন আইভোয়াককেও বের করে দেয়া হয়। ঢাকার জাহাজ মালিকদের দুটি সংগঠন বিসিভোয়া এবং কোয়াব কোঅর্ডিনেশন সেল পরিচালনা করতে থাকে। তখন থেকে শুরু হয় কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি। পরবর্তীতে আইভোয়াককে সাথে নেয়া হলেও চট্টগ্রামের নেতাদের নেতৃত্বে আসতে দেয়া হয়নি। নানা কৌশলে ঢাকার দুই সংগঠনের নেতারা কোঅর্ডিনেশন সেল পরিচালনা এবং কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করতে থাকেন। জাহাজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কত শত কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে তার হিসাব বের করা কঠিন বলে জানান জাহাজ মালিকেরা।