চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন নির্বাচনী আমেজে সরব। ৩৬ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন। পোস্টার, ইশতেহার, প্রচারণা আর স্লোগানের ভিড়ে এক বিশেষ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছেন আটজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী প্রার্থী। যারা এবার চাকসু ও হল সংসদের বিভিন্ন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের চোখে আলো কম, কিন্তু স্বপ্নের দীপ্তি তাতে একটুও ম্লান হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান প্যানেল ও স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিয়ে তারা প্রমাণ করছেন প্রতিবন্ধকতা কখনো নেতৃত্বের পথে বাধা নয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী প্রার্থীদের মধ্যে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মিজান মিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কার্যনির্বাহী সদস্য পদে। ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট প্যানেল থেকে সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী আকাশ দাস একই পদে লড়ছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সুরত আলম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক পদে। ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ) ও ছাত্রফ্রন্ট (বাসদ) সমর্থিত দ্রোহ পর্ষদ প্যানেল থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সোহেল রানা প্রার্থী হয়েছেন সমাজসেবা ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক পদে। একই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেল থেকে আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান। এবং বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেল থেকে আবিদুর রহমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কার্যনির্বাহী সদস্য পদে। চাকসুর পাশাপাশি হল সংসদেও নেতৃত্বে অংশ নিচ্ছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা। এ এফ রহমান হল সংসদে নির্বাহী সদস্য পদে প্রার্থী হয়েছেন মো. নাদিম হোসেন। অন্যদিকে বিজয় ২৪ হল সংসদে ছাত্রী সংস্থা সমর্থিত প্যানেল থেকে নির্বাহী সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আয়েশা খাতুন।
চাকসুতে স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক পদ প্রার্থী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী মো. সুরত আলম বলেন, আমরা হয়তো দৃষ্টিশক্তিতে সীমিত, কিন্তু স্বপ্নে নই। তিনি বলেন, চবি মেডিকেল সেন্টারে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার একমাত্র উপাদান হলো নাপা। আমি নির্বাচিত হলে এই ধারা পরিবর্তনে কাজ করব। পাশাপাশি চবি মেডিকেল সেন্টারকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে রূপান্তর করতে চেষ্টা করব। সমাজসেবা ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী সোহেল রানা বলেন, আমি মনে করি, সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হল যেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ও মত প্রকাশের সমান সুযোগ থাকে। ইনক্লুসিভ ও মানবিক একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হলে আমাদের ভাবতে হবে মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থান নিয়েও। সাম্প্রতিক সময়ে গাছ কাটা ও পরিবেশের অবহেলায় আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাসের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এটা আমাদের সবার উদ্বেগের বিষয়। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, শিক্ষার্থীর অধিকার এবং প্রকৃতির সুরক্ষার এই যৌথ লড়াইয়ে আমি সক্রিয় থাকব। বিশ্ববিদ্যালয় হবে সব মানুষের, প্রকৃতিরও।
কার্যনির্বাহী পদ প্রার্থী আবিদুর রহমান বলেন, চাকসুতে যদি আমাদের কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী প্রতিনিধি না থাকে তাহলে আমাদের সমস্যাগুলো কে তুলে ধরবে? কে আমাদের হয়ে কথা বলবে? যার কারণে আমি আমাদের অধিকার ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার বাস্তবায়ন করতে এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। তিনি আরও বলেন, আমাদের দৃষ্টি নেই ঠিকই, কিন্তু লক্ষ্য আছে। আমরা চাই আমাদের অবস্থান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে।
বিজয় ২৪ হলের প্রার্থী আয়েশা খাতুন বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা যে স্বাভাবিক মানুষের মত সব কিছু করতে পারে আমি সেটা দেখাতে চাই। আমি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারী শিক্ষার্থীসহ হলের সকল নারী শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করব। হলে কোনো সাংস্কৃতিক বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন হলে সেখানে আমরা আর তোমরা যে ব্যবধান সেটা দূর করব। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা কোনো কাজে আসবে না এমনটা বলে আমাদেরকে সব কাজ থেকে দূরে রাখার প্রবণতা দূর করতে কাজ করব।
সহপাঠীরা এই প্রার্থীদের অংশগ্রহণকে দেখছেন অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে। কলা অনুষদের শিক্ষার্থী সাদিয়া রহমান যেমনটি বললেন, ওরা যেভাবে প্রচারণায় যুক্ত হয়েছে, তাতে বোঝা যায় তাদের আত্মবিশ্বাস কতটা দৃঢ়। তারা আমাদেরও নতুনভাবে ভাবতে শেখাচ্ছে। আশা করি আসন্ন চাকসু নির্বাচনে তাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে। কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আদিল বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও ওরা পোস্টার করছে, প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে, আলোচনায় কথা বলছে এটাই নেতৃত্বের আসল উদাহরণ। তারা যদি নির্বাচিত হয় আশা করি তারা তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করে যাবে।
নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা গেছে, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী প্রার্থীদের সহপাঠীরা পোস্টার টানছেন, প্রচারপত্র বিলি করছেন, স্লোগান তুলছেন। কিন্তু তারাও নিজেদের মতো করে প্রচারণায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত হচ্ছেন। কেউ বক্তৃতায়, কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের ভাবনা তুলে ধরছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। এই প্রার্থীরা দেখিয়ে দিয়েছেন, নেতৃত্বের মানে কেবল ক্ষমতা নয় এটা আত্মবিশ্বাস, সাহস আর সমাজে নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার গল্প। এই শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করছেন দৃষ্টি না থাকলেও দিশা হারাতে হয় না, যদি অন্তরে থাকে জেদ, স্বপ্ন আর অটল সংকল্প। চাকসু নির্বাচনের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাই শুধু পদ–পদবির নয়, বরং মানবিক সাহস, দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তারা চোখে দেখতে পান না, কিন্তু তাদের দৃঢ়তার আলোয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আজ সত্যিই আরও একটু বেশি আলোকিত।