আমাদের হত্যা করতে হাসিনা ও কামালের নির্দেশ ছিল

ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যে আসিফ মাহমুদ

| শুক্রবার , ১০ অক্টোবর, ২০২৫ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে সমন্বয়কদের হত্যা করার নির্দেশ ছিল বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন সেই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের এই উপদেষ্টা আদালতকে বলেছেন, ২০২৪ সালে আন্দোলনের মধ্যে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর বলা হয়েছিল, কথা না শুনলে হত্যার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসাদুজ্জামান খান কামাল। সে সময় চানখাঁরপুলে ৬ জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল১ এ সাক্ষ্য দেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি ছিলেন এ মামলার ১৯ নম্বর সাক্ষী। খবর বিডিনিউজের।

২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর্যযন্ত ঘটনার বিবরণ দেন তিনি। তাকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনাও বলেন। আসিফ মাহমুদ বলেন, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই সারাদেশে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চলাকালে পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপকভাবে গুলি বর্ষণ করে। সেদিন সারাদেশে কমপক্ষে ২৯ জন আন্দোলনকারী নিহত হওয়ার খবর পান তারা। এক পর্যায়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন এবং আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বলেন। কিন্তু তারা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন। সেদিন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুড়িয়ে দিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের উপর চাপানো হয়। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং ব্লক রেইড দিয়ে ব্যাপক মাত্রায় ধরপাকড় শুরু করা হয়। সেদিন রাতে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। সেই সময়ের আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, ১৯ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানের নিকেতন থেকে মাথায় কালো টুপি পরিয়ে তাকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ পরিচয় দেওয়া সাধারণ পোশাকের কিছু লোক। সেখানে তাকে আন্দোলন প্রত্যাহারে একটি ভিডিও বার্তা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। আমি রাজি না হলে আমাকে ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। ২৪ জুলাই সকালে আমাকে নিকেতনস্থ সেই স্থানে রেখে যায়। আমাকে তুলে নিয়ে যে রুমে রাখা হয় তা ৫ আগস্ট পরবর্তীকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আয়না ঘর পরিদর্শনে গিয়ে বুঝতে পারি যে এটি সেই জায়গা। ছাড়া পেয়ে তিনি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি হন; সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামও (এখন এনসিপির আহ্বায়ক) ওই হাসপাতালে ভর্তি হন। আসিফ মাহমুদ বলেন, হাসপাতালে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাদের নজরদারিতে রাখে; তাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।

সাক্ষ্যে তিনি বলেন, ২৬ জুলাই গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় নাহিদ ইসলাম, আবু বাকের মজুমদার এবং তাকে হাসপাতাল থেকে তুলে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৭ জুলাই সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকেও ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। ২৮ জুলাই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাস্‌সুমকেও ডিবি কার্যালয়ে দেখেন তারা। সেখানে আমাদেরকে আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদেরকেও ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। তাদেরকে দিয়ে আমরা সুস্থ আছি মর্মে মিডিয়ায় বক্তব্য প্রচারে বাধ্য করা হয়।

তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুনুর রশীদ এবং রমনা জোনের ডিসি হুমায়ুন কবীর আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য চাপ ও হুমকি দেন বলে সাক্ষ্য দেন আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, আমাদেরকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে আন্দোলন প্রত্যাহারে জন্য চাপ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। আমাদেরকে বারবার বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই আমাদেরকে তুলে আনা হয়েছে এবং আন্দোলন প্রত্যাহারের চাপ দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে আমাদের হত্যা করা হবে মর্মে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল। তারা আরও বলে যে, তারা দয়া করে আমাদেরকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে।

জবানবন্দিতে আসিফ মাহমুদ বলেন, ডিবির লোকজন একটি লিখিত বক্তব্য জোরপূর্বক স্বাক্ষর করিয়ে তাদেরকে দিয়ে পাঠ করায় এবং সেটি মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করে গণমাধ্যমে প্রচার করে। আন্দোলন দমাতে হত্যাযজ্ঞের জন্য তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ যাদের কমান্ডিং অথরিটি ছিল তাদের এবং যারা সরাসরি গুলি করেছেন তাদেরকে দায়ী করেন।

আসিফ মাহমুদ বলেন, আমি মনে করি আন্দোলন দমনের এ সকল কার্যক্রমের জন্য তারা দুজন (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) প্রধানত দায়ী। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনা কর্তৃক আন্দোলনকারীদের উপর লেথাল উইপন ও হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যার নির্দেশনার বিষয়ে জানতে পারি। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও জানতে পারি, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ওয়্যারলেস মেসেজের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানোর জন্য তার অধীনস্তদের নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচমেক হাসপাতাল থেকে চোরাই মালামাল ও ওষুধসহ গ্রেপ্তার ২
পরবর্তী নিবন্ধঘুষি মেরে বিমানের মনিটর ভাঙলেন যাত্রী