গাজার পানে দুর্নিবার যাত্রা: ‘ব্যর্থ’ সুমুদ ফ্লোটিলার পালে স্বাধীনতার হাওয়া

ইয়াসির সিলমী | বৃহস্পতিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২৫ at ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ

উত্তাল সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে যে নৌবহরটি অবরুদ্ধ গাজার দিকে এগিয়ে গেছে, তাকে শুধু ত্রাণবাহী জাহাজ বললে ভুল হবে। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নামক এ নৌবহরটি বিশ্ববিবেকের এক সম্মিলিত উচ্চারণ, মানবতার চরম ব্যর্থতার বিরুদ্ধে এক কঠিন প্রতিবাদ। তাদের গন্তব্য একটি অবরুদ্ধ উপকূল, যেখানে লাখো মানুষ অনাহারে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। রয়েছে হাজারো শিশু, যারা কোন সংঘাত বোঝে না, তারা আজ ক্ষুধা, অপুষ্টি আর রোগের নির্মম শিকার। এই দৃশ্যপট কল্পনাতীত বেদনায় ভরা।

সুমুদ ফ্লোটিলার এ যাত্রা বুধবার রাত থেকে বিশ্ববাসী চরম উৎকণ্ঠায় অবলোকন করছে। যখন থেকে ইসরায়েলি নৌবাহিনীর বাধার মুখে পড়েছে। বুধবার রাত থেকে শুক্রবার দুপুরের মধ্যে সুমুদ ফ্লোটিলার ৪৪ টি নৌযানই আটক করেছে ইসরায়েল। অন্যদিকে এ বহরে থাকা বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম শুক্রবার দুপুরে এক লাইভে জানিয়েছেন, তাদের বহনকারী নয়টি নৌযান সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আলাদা হয়ে এখনো মুক্ত আছে এবং গাজার উদ্দেশ্যে ছুটছেন। এছাড়াও আরও কিছু নৌকা নতুন করে গাজা অভিমুখে রওনা দিয়েছে। তারা শেষপর্যন্ত গাজায় পৌঁছাতে পারুক বা আটক হোক, ইতিহাস এই যাত্রাকে মনে রাখবে মানবতা ও সাহসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে।

এই ঐতিহাসিক যাত্রার মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থসুমুদ ফ্লোটিলা দুটি বার্তা দিয়ে গেছে। প্রথমত, এটি জীবন রক্ষাকারী ত্রাণ নিয়ে গেছে। এর পরিমাণ হয়তো পর্যাপ্ত নয়, তবে প্রতীকী গুরুত্ব অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, এটি ইসরায়েল আরোপিত অবৈধ ও অনৈতিক নৌ অবরোধকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, যা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার স্বপ্নকে দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছে।

গাজায় চলমান সামরিক অভিযানের ভয়াবহতা কেবল ধ্বংসস্তূপ আর বোমার শব্দে সীমাবদ্ধ নয়, এর সবচেয়ে মর্মস্পর্শী দিক হলো পরিকল্পিত অনাহার। খাবারের অভাবের কারণে শিশুরা হাসপাতালে মারা যাচ্ছে, যাদের শরীর হাড়জিরজিরে, চোখগুলো ফ্যাকাশে। জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বারবার সতর্ক করেছে যে গাজায় দুর্ভিক্ষ চলছে, আর এই দুর্ভিক্ষের শিকার হচ্ছে মূলত শিশুরা। যারা এই যুদ্ধের কোনো পক্ষ নয়।

যখন খাদ্য, পরিষ্কার জল এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম পৌঁছানো অসম্ভব করে তোলা হয়, তখন তা আর সামরিক অবরোধ থাকে না, তা পরিণত হয় মানবতার বিরুদ্ধে এক সংগঠিত অপরাধে। শিশুর জন্য খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করা কেবল দয়ার বিষয় নয়, এটি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের মৌলিক বাধ্যবাধকতা।

সুমুদ’ একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো অবিচলতা বা অদম্য সহনশীলতা। ফ্লোটিলাটি এই নামটি গ্রহণ করে ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘদিনের প্রতিরোধ ও টিকে থাকার মানসিকতাকে সম্মান জানিয়েছে। এটি বিশ্বের ৪৪টি দেশের ডাক্তার, শিল্পী, সাংসদ, আইনজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মীসহ সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে গঠিত, যাদের সংখ্যা প্রায় ৫০০ জন।

এই বহরের উদ্দেশ্য হল নৌ অবরোধ ভেঙে গাজায় সরাসরি ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় অবাধ চলাচলের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তারা মনে করেন, যদি সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রাজনৈতিক কারণে অবরোধ ভাঙতে ব্যর্থ হয়, তবে নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্ব হলো এই নীরব গণহত্যায় নিষ্ক্রিয় না থাকা।

এই যাত্রায় বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব অংশ নিয়েছেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন সুইডেনের জলবায়ু ও রাজনৈতিক অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, বার্সেলোনার সাবেক মেয়র, নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি ম্যান্ডলা ম্যান্ডেলা, এবং বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম।

এই বহরে শহিদুল আলমের উপস্থিতি যেন সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের সংহতির প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের কোটি মানুষ, যারা দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রতি অকৃত্রিম সমর্থন জানিয়ে আসছেন, শহিদুল আলমের যাত্রা তাদের সেই অদম্য আশা বহন করছে। তিনি তাঁর ক্যামেরার লেন্স ছেড়ে সশরীরে সেই অন্যায়ের সামনে দাঁড়িয়েছেন, যার সাক্ষী হওয়ার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তার ভাষায়, ত্রাণ দিতে নয়, দখলদারদের অবরোধকে চ্যালেঞ্জ করাই তাদের বহনকারী নয়টি নৌযানের লক্ষ্য।

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার যাত্রা অবশ্য নতুন কিছু নয়। এটি হলো গাজাকে মুক্ত করার জন্য নানা দেশের নাগরিক সমাজের উদ্যোগে সংগঠিত দীর্ঘ সংগ্রামের সর্বশেষ ও সবচেয়ে বড় অধ্যায়। এই ইতিহাসের পাতায় বহু ত্যাগ ও রক্তপাতের কাহিনি লেখা আছে, যা এই অভিযানের ঝুঁকিকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

স্মরণ করা যেতে পারে ২০১০ সালের মাভি মারমারা ট্র্যাজেডি। সেবার আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছিলেন দশজন শান্তিকর্মী। যারা গাজায় ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছিলেন। এরপর ২০১১, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৮ এবং চলতি বছরেও একাধিক ফ্লোটিলাকে জোরপূর্বক আটক করা হয়েছে। এই প্রতিটি ঘটনাই প্রমাণ করে যে গাজার দিকে নৌকায় করে যাওয়া কতটা বিপজ্জনক। এই ইতিহাস জেনেও সুমুদ ফ্লোটিলার যাত্রা অবিচলতার চূড়ান্ত উদাহরণ। যা প্রমাণ করে ন্যায়বিচারের জন্য মানুষ প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। সেইসাথে প্রমাণ করে ইসরায়েল কেন গাজায় কারো উপস্থিতি চায় না। ফ্লোটিলার প্রতিটি সদস্য জানেন, তারা কী চরম ঝুঁকিপূর্ণ পথে পা বাড়িয়েছেন।

ফ্লোটিলার এই মানবিক উদ্যোগে ইসরায়েলি বাধা গভীরভাবে আইনি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। গাজার এই অবরোধকে আন্তর্জাতিক আইন ও বহু রাষ্ট্রের মতানুসারে অবৈধ বলে গণ্য করা হয়। আন্তর্জাতিক জলসীমায় কোনো দেশের বেসামরিক ও ঝুঁকিমুক্ত জাহাজে সামরিক হস্তক্ষেপ করা চরমভাবে আইনের পরিপন্থী।

ফ্লোটিলা সংশ্লিষ্টরা জোর দিয়ে বলছেন, তাদের যাত্রা সম্পূর্ণ আইনসম্মত। কিন্তু যখন একটি সামরিক শক্তি গাজার উপকূল থেকে বহুদূরে বেসামরিক ত্রাণবাহী জাহাজকে থামিয়ে দেয়, তখন প্রশ্ন ওঠে: আন্তর্জাতিক আইন কি শুধুমাত্র ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কাজ করবে? অবরোধের বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি করাই ফ্লোটিলার অন্যতম লক্ষ্য।

আগেরগুলোর তুলনায় এবারের নৌবহরকে বলা হচ্ছিল সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা। এর কর্মীরা আশা করেছিলেন, বিপুল সংখ্যক নৌকা থাকার কারণে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের জন্য সবগুলো আটকানো কঠিন হবে। কিন্তু না। তাদের আশাকে হতাশায় রূপ দিয়ে এবারও গাজা যাত্রাকে ভন্ডুল করার সবরকম কৌশল প্রয়োগ করেছে দখলদার বাহিনী।

যার জেরে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। তবুও অনড় দখলদাররা। তারা ফ্লোটিলাকে থামিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, সমানে গাজায় চালিয়ে গেছে আগ্রাসন। ২০২৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা কেবল ঢেউয়ে দুলছে না, এটি দুলিয়ে দিচ্ছে বিশ্বের রাজনৈতিক স্থবিরতাকে। গাজার শিশুদের সেই ক্ষুধার্ত মুখগুলোই হলো এই নৌবহরের নৈতিক চালিকাশক্তি। ত্রাণের প্রতিটি প্যাকেট আর ওষুধের প্রতিটি শিশি তাদের জন্য জীবন।

এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ন্যায়বিচার ছাড়া শান্তি অসম্ভব, এবং স্বাধীনতা ছাড়া মানুষের মর্যাদা অর্থহীন। স্বাধীন ফিলিস্তিন শুধু একটি ভূখণ্ডের নাম নয়, এটি হলো সেই নৈতিক মানদণ্ড, যেখানে প্রতিটি মানুষের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে, এবং কোন শক্তিই কোন জাতিকে অনাহারে রেখে বশীভূত করতে পারবে না।

সুমুদ ফ্লোটিলা হয়তো তার ভৌগোলিক গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই যাত্রা ইতিহাসের পাতায় চিহ্নিত হয়ে থাকবে মানবতার শেষ আশা হিসেবে। এই যাত্রা প্রমাণ করল, অবরুদ্ধ হলেও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন আজও টিকে আছে। আর সেই স্বপ্নের পাল ধরতে সারা বিশ্বের মানুষ প্রস্তুত। গাজাবাসীর জন্য এটিই সম্মিলিত সুমুদঅবিচলতা।

লেখক: চেয়ারম্যান ইনচার্জ, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম