দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৮ অক্টোবর, ২০২৫ at ১১:০৭ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আজন্ম মনে রাখবার মতো নানা আয়োজনে সম্পন্ন প্যাঙ্গুইন প্যারেড দেখে ফিরতি পথ ধরলাম। মহাসাগরের পাড়ে অতি আদরে থাকা বনানীর ভিতরকার পথ মাড়িয়ে বেরিয়ে আসলাম গেটের বাইরে। অনেক মানুষ। সবই দেশি বিদেশী পর্যটক। একদল পেঙ্গুইনকে পুঁজি করে কত লাখ ডলারের ব্যবসা করছে তারা তার কোন হিসেব কষতে পারলাম না। তবে এমন একটি আয়োজন বছরে কোটি কোটি ডলার আয়ের পথ যে সুগম করেছে তা বুঝতে পারছিলাম। একটির পর একটি গাড়ি আসছিলো, পর্যটকেরা নিজেদের গাড়িতে চড়ে দ্বীপ ছাড়ছিলেন। আমাদের গাড়িও অপেক্ষা করছিল। ড্রাইভারকে ফোন করতে অল্পক্ষনের মধ্যে কোত্থেকে যেনো আমাদের গাড়িও হাজির হলো। আমরা একে একে গাড়িতে চড়ে বসলাম।

এবার ফিরতি যাত্রা, মেলবোর্ন শহরে, হোটেলে। আসার সময় প্রায় দুই ঘন্টার মতো লেগেছিল। এখন ফেরার সময় রাতের বেলা সময় কিছুটা কম লাগবে নাকি আরো বেশি লাগবে তা বুঝতে পারছিলাম না। বিদেশে ড্রাইভারদের সাথে এসব বিষয় নিয়ে আমি পারতপক্ষে কথা বলিনা। কোনকারণে এরা রাগ করলে কর্মকাবার করে দেবে! অতএব অপেক্ষা এবং দেখার চেয়ে ভালো কোন সুরাহা আপাততঃ আমার মনে পড়লো না।

ফিলিপ আইল্যান্ডের সন্ধ্যাটা ভুলতে পারছিলাম না। দিগন্তজোড়া সমুদ্রের ওপর যখন শেষ সূর্যালোক ফিকে হয়ে উঠলো, তখনি চারদিকে কলকলিয়ে উঠলো জ্যোৎন্সা। এমন সুন্দর একটি দিনে এখানে আসার আয়োজন থাকায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো। কারণ জ্যোৎস্না না থেকে মেঘে মেঘে পুরো আকাশ ঢেকে থাকতে পারতো! কিংবা আমাবশ্যার সময়ও পেঙ্গুইন প্যারেড দেখতে আসতে হতে পারতো!

চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙ্গার কথা বহুবার শুনেছি, লিখেছি। কিন্তু এই মহাসাগরের পাড়ে বসে চাঁদের বাঁধ ভাঙ্গা আলো যে কেমন মন ছুুঁয়ে দিতে পারে তা যেনো নতুন করে টের পেলাম। চাঁদের আলোয় দ্বীপের গাছপালা, সমুদ্রতীর আর পাথুরে ঢাল সবকিছুই আলোকিত হয়ে উঠল। এই আলো চোখে লাগছিল না, কেমোন যেনো মোলায়েম পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিলো।

ঘড়ি দেখলাম, রাত আটটা ছুঁইছুঁই। ফিলিপ আইল্যান্ডের বিখ্যাত পেঙ্গুইন প্যারেডের পর্যটকদের ভিড় একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে। আমাদের গাড়ি যাত্রা করলো। সামনেই ফিলিপ আইল্যান্ড রোড, যা সোজা গিয়ে যুক্ত হয় সান রেমো ব্রিজের সঙ্গে। পেছনে সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাস আর সামনে ভরা জ্যোৎন্সায় স্নানরত মসৃন পথ। চাঁদের আলো এতো চমৎকারভাবে চারদিক ভরিয়ে রেখেছে যে, গাড়ির হেডলাইট না জ্বালিয়েও মনে হয় চালানো যেতো।

আইল্যান্ড থেকে বের হওয়ার পর রাস্তার বেশ কিছু অংশ একেবারেই নিরিবিলি। রাস্তার দু’পাশে নিচু ঝোপঝাড়, ইউক্যালিপটাস গাছ আর মাঝে মাঝে খোলা ঘাসের চত্বর। আলোতে ছায়া পড়ে গাছগুলোকে অনেক লম্বা লাগছিলো। ঝোপের ভেতর থেকে হঠাৎ হঠাৎ কোন এক প্রাণীর ডাক ভেসে আসছিল। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে, এগুলো ওয়ালাবি। অনেকটা ক্যাঙ্গারুর মতো, তবে ক্যাঙ্গারু নয়। ড্রাইভার হাতের ইশারায় আমাকে প্রাণীটি দেখালেন। রাস্তার পাশ দিয়ে দিব্যি লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিল। এতো বড় গাড়ি যাচ্ছে, অথচ প্রাণীগুলোর ভিতরে কোন ঢর ভয় নেই। রাস্তার উপর হেলে দুলে চলা পসামও ড্রাইভার দেখালেন। এটি ছোট বিড়ালের মতো একটি প্রাণী, গাছে বাস করে। তবে এই রাতের বেলায় সেগুলো খাবার খুঁজছিলো বলে ড্রাইভার জানালেন। আমি বেশ খেয়াল করে দেখলাম যে, গাড়ির শব্দে ওয়ালাবি কিংবা পসামদের কোন ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না। তারা নিশ্চিত যে, এসব গাড়ি কিংবা মানুষ তাদের কোন ক্ষতি করবে না। আমরা গাড়ির এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিয়েছি। প্রকৃতি দেখার সুবিধার জন্য এমনটি করে নিলাম। দূর থেকে মহাসাগরের ঢেউয়ের শব্দ আর মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপ্টা পুরো পরিবেশটাকে একটি ঘোরলাগা মোহনীয় করে তুলছিল।

একটি ব্রিজের উপর আমাদের গাড়ি উঠলো। ড্রাইভার জানালো যে ব্রিজটির নাম সান রেমো ব্রিজ। এটিই দ্বীপকে স্থলভাগের সাথে যুক্ত করেছে। আর কোন ব্রিজ আছে কিনা জানি না, জিজ্ঞেসও করিনি। জিজ্ঞেস করার মতো অবস্থাও ছিল না। কারণ ব্রিজের উপর থেকে নিচে তাকিয়ে আমার ভিতরটা রোমাঞ্চে ভরে গেলো। কী যে সুন্দর চাঁদ! ব্রিজের নিচের অন্ধকারে পানির ওপর আলোকিত চাঁদ যেন বড় একটি সোনালি থালার মতো ভাসছে। সাগরের ঢেউ ব্রিজের পিলারে আছড়ে পড়ে আবার ফিরে যাচ্ছে। পানির গায়ে খেলা করছে চাঁদের আলো, ছড়িয়ে দিচ্ছে চিকচিকে এক রূপালি আভা। ব্রিজের দুই পাশে লোলেভেল লাইট আলো ছড়াচ্ছিলো, কিন্তু সেই আলো চাঁদের আলোর কাছে যেনো লজ্জা পাচ্ছিলো।

আমরা ব্রিজ পার হয়ে শহরের দিকে এগুচ্ছিলাম। রাস্তার দু’পাশে আলোকিত দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, ফিশঅ্যান্ডচিপস শপ, ছোট কফি হাউস আর গিফট স্টোরে আলো জ্বলজ্বল করছিলো।

আমাদের গাড়ির গতি বেশ বাড়ালো বলে মনে হলো। এখানে স্পিড লিমিট কত জানি না, তবে স্পিডমিটারে চোখ দিয়ে দেখলাম যে, গাড়ি ছুটছে ১২৫ কিমি বেগে। গাড়ির গতি বাড়ার সাথে সাথে বাতাসের তোড়ও বাড়ছিল। জানালার কাচ নামিয়ে গাড়িতে বসা সম্ভব হচ্ছিলো না। আমরা গাড়ির কাচ বন্ধ করে এসি চালিয়ে দিতে বললাম।

গাড়ির গতি আবারো কমে গেলো। সান রেমো পার হওয়ার পর কোস্টাল রোডের সরু ও আঁকাবাঁকা পথ শুরু হলো। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেশ কম। আমাদের আগে বা পেছনে তেমন কোন গাড়ি দেখা গেলো না। রাস্তার দু’পাশে গাছ এবং ঘাসের রাজত্ব। কোন বাড়িঘর আছে বলে মনে হচ্ছিলো না। আমি কাচ একটু নামালাম। একটি বুনো গন্ধ নাকে লাগলো। প্রচুর ইউক্যালিপটাস ও পাইনগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার দু’পাশ জুড়ে বনবনানী। এমন জ্যোৎস্নায় বনে বসে থাকতে পারলে মন্দ হতো না।

আমরা যে বনের ভিতর দিয়েই যে যাচ্ছি তা টের পেলাম কয়েকটি সাইনবোর্ড দেখে। রাস্তার কয়েকটি মোড়ে ইংরেজিতে ‘বণ্যপ্রাণী পারাপার’ এর সতর্কবার্তা লিখে দেয়া হয়েছে। আমাদের গাড়ির গতি বেশ কম, রাস্তার উপর দিয়ে বিভিন্ন ধরণের প্রাণীর পারাপার দেখছিলাম। কয়েকটি স্থানে দেখা গেলো, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পসাম এবং শেয়ালের মতো এক ধরণের প্রাণী গাড়ির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কয়েকটি প্রাণীকে দেখলাম, আমাদের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বনের ভিতরে ঢুকে গেলো।

বনের ভিতর দিয়ে এগুচ্ছিলাম। বেশ কিছুদূর আসার পর আর্থার সিট রোডের সংযোগ পাওয়া গেলো। পাহাড়ি অঞ্চল। তবে রাস্তাটি বেশ উন্নত, ডাবল লেইন। প্রতিটি মোড়ে ক্যাট’স আই, আর সাদাহলুদের আলোর দাগ এঁকে রাখা হয়েছে। লেইন ধরে গাড়ি চলছে। কারো সাথে কারো ঠোক্কর খাওয়ার শংকা নেই। অবশ্য, এসব দেশে রাস্তায় সবই দ্রুতগতির গাড়ি। স্লো ভেহিক্যাল না থাকার কারণে কেউ কাউকে খুব একটা ঠোক্কর দেয়ার সুযোগ পায় বলেও মনে হলো না।

আমরা এগিয়ে চলেছি। টের পেলাম যে, আমরা হাইওয়েতে পৌঁছে গেছি। বিশাল রাস্তা, চওড়া। কত লেনের কে জানে। মাঝখানে ডিভাইডার, দুইপাশে চার পাঁচটি করে লেইন। অনেক গাড়ি। অবশ্য, সবই ছুটছিল বিপুল বেগে। আমাদের গাড়ির স্পিডও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। চাঁদের আলো মনে হলো কিছুটা মরে এসেছে। দূরে দেখা যাচ্ছিলো শহুরে বৈদ্যুতিক আলোর আভা। হাইওয়ের পাশে কোথাও কোথাও ফার্মহাউস, চারণভূমি আর ছোট ছোট লেকের মতো দেখা যাচ্ছিলো। লেকের পানিতে চাঁদের প্রতিবিম্ব কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমার মনে হলো, চাঁদ কেবল বনেই নিজেকে উজাড় করে দেয়, শহরে নয়। রাস্তার পাশের ফার্ম হাউজ এবং চারণভূমিগুলোতে অনেকগুলো গরুর পাল দেখা গেলো। অস্ট্রেলিয়ান গরু। এগুলো এক একটি কয়েক মন করে নাকি দুধ দেয়। অস্ট্রেলিয়ার দুধ আমাদের দেশেও আমদানি করা হয়। এসব গরুর দুধ আমরাও চায়ে মেশাই কিনা কে জানে! গরুগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে রাস্তা ধরে ছুটে চলা গাড়ি দেখছে।

একটু পাহাড়ের মতো জায়গায় উঠছিলো আমাদের গাড়ি। সমতল পথ ছেড়ে হঠাৎই আবার পাহাড় কেনো বুঝতে পারছিলাম না। ভুল পথে ছুটছে না তো! কিন্তু একটু এগুতেই পাহাড়ের উপর থেকে দেখা গেলো ঝলমলে মেলবোর্ন শহর। অনেক দূর থেকেও মনে হচ্ছিলো একটি তারার মালা কোন উর্বশীর গলায় ঝুলে রয়েছে।

পাহাড়ী পথ ছেড়ে আবারো সমতলে ছুটলো আমাদের গাড়ি। একটি টোলপ্লাজার সামনে এসে থামলো। টোল বুথের ধাতব দেয়ালে চাঁদের আলো আর ইলেকট্রিক লাইট ঠিকরে ঠিকরে বেরুচ্ছিল। টোল প্লাজায় গাড়ির তেমন ভিড় নেই। আমাদের গাড়ির টোল ইলেক্ট্রনিক্স সিস্টেমে পরিশোধ করে দিয়ে গাড়ি সামনে এগুলো। রাস্তার পাশে সারি সারি বিলবোর্ড, বিশাল বিশাল। সেগুলোতেও আলো জ্বলছিল। বিলবোর্ডগুলোর কোনটিতে গাড়ির বিজ্ঞাপন, কোনটিতে বিমার। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন হাউজ ডে’র বিজ্ঞাপনও রয়েছে। রয়েছে আরো নানা ঘোষণা, আয়োজন। চাঁদের আলোর সাথে বৈদ্যুতিক আলো মিলেমিশে বিলবোর্ডগুলোকে ভিন্ন একটি আবহ দিয়েছে। আমরা শহরের একেবারে কাছাকাছিতে পৌঁছে গেছি। চাঁদের আলোর জোর বেশ কমে এসেছে। তবে পেঙ্গুইন প্যারেড দেখে ফেরার পথে পেছনে ফেলে আসা চাঁদনি রাতের মোহনীয় আবহ আমার অন্তর জুড়ে খেলা করছিলো। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষাগুরু মিহির কান্তি শীল
পরবর্তী নিবন্ধসুফিবাদ, মাজার সংস্কৃতি ও হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রঃ) : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ