গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনার লক্ষ্যে মিশর পৌঁছেছেন হামাসের কর্মকর্তারা। এ আলোচনা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটি ঘিরে গত দুই বছর ধরে যে অমানবিক যুদ্ধ চলছে তার অবসান হবে এবং জিম্মিরা ঘরে ফিরবে বলে আশা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে, আলোচনার পথ একেবারেই সহজ নয়। এতে রয়েছে বহু জটিলতা, বিশেষ করে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং গাজার ভবিষ্যৎ শাসন কাঠামো নিয়ে।
লোহিত সাগর তীরবর্তী অবকাশযাপন কেন্দ্র শার্ম আল–শেখে আলোচনায় অংশ নিতে কৌশল বিষয়কমন্ত্রী রন ডারমারের নেতৃত্বে ইসরায়েলের প্রতিনিধিরা সোমবার মিশর যাচ্ছেন। হামাসের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীটির নির্বাসিত নেতা খলিল আল–হায়া। তিনি গত রোববার মিশর পৌঁছেছেন। তার নেতৃত্বেই হামাসের কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলবেন। গত মাসে কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণে বেঁচে ফেরার পর হায়ার এটিই প্রথম মিশর সফর।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি প্রস্তাবের ভিত্তিতে এই আলোচনায় বসেছে দুই পক্ষ। আলোচনাটি শুরু হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন গাজা যুদ্ধের দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে যুদ্ধ থামানোর জন্য। তবে, আলোচনার পথ একেবারেই সহজ নয়। এতে রয়েছে বহু জটিলতা, বিশেষ করে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং গাজার ভবিষ্যৎ শাসন কাঠামো নিয়ে। ট্রাম্পের উপস্থাপিত পরিকল্পনায় তিন ধাপের কথা বলা হয়েছে। বন্দি বিনিময়, ধাপে ধাপে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে সেখানে। হামাস অবশ্য এখনো সরাসরি প্রস্তাবে সায় দেয়নি, তবে আলোচনার মাধ্যমে সম্ভাবনা যাচাই করছে। মিশরীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখনকার আলোচনায় মূলত বন্দি বিনিময়ের প্রক্রিয়া ও যুদ্ধবিরতির পর্যায়ভিত্তিক কাঠামো নিয়ে কথা হচ্ছে।
মিশরে আলোচনা সম্বন্ধে অবগত এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগে একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি তৈরি করার দিকেই আলোচকরা নজর দেবেন। তিনি বলেন, এবারেরটি আগের আলোচনাগুলোর থেকে আলাদা হবে। আগের আলোচনাগুলোতে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ধাপে ধাপে কার্যকরের। সেসব ক্ষেত্রে প্রথম ধাপের ব্যাপারে ঐকমত্য হতো, এরপর যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ধাপগুলো নিয়ে আরও আলোচনা লাগতো। ওই পর্যায়ে গিয়েই আগের আলোচনাগুলো ভেস্তে যেত, এই দৃষ্টিভঙ্গি এড়ানোর ব্যাপারে এবার আলোচকদের সচেতন চেষ্টা থাকবে।
এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, বাস্তব প্রস্তুতি ও কীভাবে বাস্তবায়ন হতে পারে তা নিয়ে কৌশলগত আলোচনা দেখেই আমরা খুব দ্রুত বুঝতে পারবো হামাস আদৌ সিরিয়াস কিনা। পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও জানান, আলোচনা দ্রুত এগুচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে তিনি বলেছেন, আমাকে বলা হয়েছে প্রথম ধাপ এই সপ্তাহেই শেষ হবে। আমি সবাইকে আরও দ্রুত অগ্রসর হতে বলেছি।
রয়েছে বড় চ্যালেঞ্জ : ইসরায়েল চায় হামাসকে দ্রুত নিরস্ত্র করতে হবে, তবে নির্দিষ্ট সময়সীমা নিয়ে এখনও অস্থিরতা রয়েছে। গাজায় ইসরায়েলি সেনা থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়েও মতানৈক্য প্রকট। হামাস গাজা শাসন করবে, নাকি আন্তর্জাতিক কোনও প্রশাসন হবে–এই প্রশ্নও উন্মুক্ত।
গত শুক্রবার হামাস ওই পরিকল্পনার জিম্মি মুক্তি এবং আরও কিছু অংশের ব্যাপারে তাদের সম্মতি জানালেও অস্ত্র সমর্পণসহ কয়েকটি বিষয়ে কোনো অবস্থান জানায়নি। সশস্ত্র এ গোষ্ঠীটি দীর্ঘদিন ধরেই আত্মসমর্পণের প্রস্তাব খারিজ করে আসছিল।
ফ্লোটিলার ১৭১ জনকে ফেরত : এদিকে গাজাগামী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হওয়া মানবাধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ ১৭১ জনকে গকাল সোমবার ইউরোপের দেশ গ্রিস ও স্লোভাকিয়ায় পাঠানো হয়েছে।
এর আগে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক থাকার সময় অমানবিক আচরণের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন এই মানবাধিকর্মীদের অনেকেই। সুইজারল্যান্ড ও স্পেনের কয়েকজন কর্মীর অভিযোগ, আটকাবস্থায় তারা অমানবিক পরিস্থিতিতে ছিলেন। তবে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইসরায়েল গতকাল থুনবার্গসহ ১৭১ জন আটক ফ্লোটিল্লা কর্মীকে বহিষ্কার করার কথা জানিয়েছে। তারা গ্রিস, ইতালি, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন, পোল্যান্ড, জার্মানি, বুলগেরিয়া, লিথুয়ানিয়া, অস্ট্রিয়া, লুঙ্মেবার্গ, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, স্লোভাকিয়া, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, সার্বিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। ইসরায়েলের বিচারমন্ত্রী ইয়ারিভ লেভিন জানান, আরও ৩০৯ জন ফ্লোটিল্লা কর্মী আটক আছেন। এদের মধ্যে ২০০ জনকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত পাঠানো হবে।
বাধ্য করেছে টয়লেটের পানি খেতে : গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আটককৃতদের অভিযোগ, কয়েকদিন ধরে খাবার দেওয়া হয়নি তাদের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটু গেড়ে থাকতে বাধ্য করেছে ইসরায়েলি সেনারা। কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে, এমনকি টয়লেটের পানি পান করিয়েছে।
গতকাল আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটককৃত অধিকারকর্মীরা ছাড়া পাওয়ার পর তাদের ওপর হওয়া নৃশংস আচরণের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তারা জানান, ইসরায়েলি সেনারা তাদের মারধর করেছিল, জিপ টাই দিয়ে হাত বেঁধে রেখেছিল এবং প্রিজন ভ্যানে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রেখেছিল। ইতালির অধিকারকর্মী সিজার তোফানি রোমের ফিউমিসিনো বিমানবন্দরে ফিরে এসে বলেন, আমাদের সঙ্গে ভয়াবহ আচরণ করা হয়েছে, হয়রানি করা হয়েছে। দেশটির ইউনিয়ন অব ইসলামিক কমিউনিটির সভাপতি ইয়াসিন লাফ্রাম বলেন, ইসরায়েলি সেনারা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করেছিল। নিজেদের গণতান্ত্রিক দেশ বলে দাবি করা রাষ্ট্রে এমন আচরণ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
তুরস্কের ইস্তানবুলে ফিরে এপির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অধিকারকর্মীরা জানান, কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তাদের ভয় দেখানো হয়েছিল, বন্দুকের লেজার লাইট তাক করানো হয়েছিল এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা শারীরিকভাবে অত্যাচার করা হয়েছিল। মালয়েশিয়ার অভিনেত্রী ও গায়িকা হেলিজা হেলমি ও হাজওয়ানি হেলমি বলেন, আমাদের টয়লেটের পানি খেতে বাধ্য করা হয়েছিল। অনেকেই অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু ইসরায়েলি সেনারা কোনো সহানুভূতি দেখায়নি। হেলিজা জানান, তিন দিন ধরে তিনি খাবার পাননি, কেবল টয়লেট থেকে পানি খেয়ে বেঁচে ছিলেন।
ফ্লোটিলার আগে আটককৃতরা অভিযোগ করেছিলেন, গ্রেটা থুনবার্গকে মাটিতে টেনে নেওয়া, ইসরায়েলি পতাকায় চুমু খেতে বাধ্য করা এবং মিথ্যা প্রচারণার কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল।