বাংলা সাহিত্যে এমন কিছু নাম আছে, যাঁদের জীবনকাল যত ছোট, অবদান ততই বিস্ময়কর। সেই তালিকায় সবচেয়ে উজ্জ্বল একজন হলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। মাত্র একুশ বছরের আয়ু, কিন্তু সেই অল্প বয়সেই তিনি বাংলা কবিতায় আগুনের মতো ঝলসে উঠেছেন। তাঁর কবিতা যেন একসঙ্গে সাহিত্যের ভাষা ও সংগ্রামের হাতিয়ার। এই কবি সমাজের নিপীড়িত, শোষিত মানুষের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন তাঁর লেখনিতে। সুকান্ত শুধু কবিতা লেখেননি, তিনি কবিতাকে মানুষের মুখের ভাষা, প্রতিবাদের ভাষায় রূপান্তরিত করেছেন।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট, কলকাতায়। তাঁর পরিবার ছিল সাংস্কৃতিকভাবে সচেতন ও সাহিত্যানুরাগী। ছোটবেলা থেকেই তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। পড়াশোনা করেন বেলেঘাটা দেশবন্ধু স্কুলে এবং পরে কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল স্কুলে। তবে নিয়মিত স্কুলজীবন খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, কারণ অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং লেখালেখি ও আন্দোলনই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের মূল প্রতিশ্রুতি। সুকান্ত ছাত্রাবস্থায়ই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির যুব সংগঠন ‘প্রযুক্তি সংঘ’–এর সক্রিয় কর্মী এবং পরে ‘যুব ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। তাঁর কবিতায় তাই বারবার উঠে আসে শ্রেণিসংগ্রাম, শোষণ–বিরোধিতা, খিদে, দারিদ্র্য এবং এক নতুন সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা। তাঁর ভাষা ছিল জোরালো, সরল, এবং স্পষ্ট–যা সহজেই সাধারণ মানুষের হৃদয়ে পৌঁছাতে পারত।
সুকান্তের কাব্যজীবন দীর্ঘ না হলেও ছিল বিস্ময়করভাবে পরিণত ও প্রভাবশালী। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে ‘ছাড়পত্র’, ‘ঘুম নেই’, ‘পূর্বরাগ’, ‘মিঠেকড়া’, ‘অভিযান’, ‘হরতাল’, এবং মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘চেতনার রঙ’। তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো–সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের যন্ত্রণাকে সাহিত্যে তুলে আনা, তা যেন রূপকল্প নয়, একেবারে বাস্তব।
এক বিখ্যাত কবিতায় তিনি লেখেন–
“খিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এই আমার অঙ্গীকার।
আমি ক্লান্ত, তবু থামিনি–
আমি সেই ছাত্র, আমি সেই শ্রমিক, আমি সেই কৃষক
যার রক্তে লেখা হয় বিপ্লবের ইতিহাস।”
এই পংক্তিতে দেখা যায়, তিনি কেবল একজন কবি নন, বরং একজন যোদ্ধা, যার অস্ত্র ছিল কলম। খিদে, দারিদ্র্য ও বঞ্চনা ছিল তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান বিষয়। ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থে তিনি লিখেছেন–
“পুঁথির মুখস্থ বুলিতে নয়,
আমি জানি খিদে কী জিনিস।
খিদে মানে কাঁদতে থাকা মা,
অন্ন না পেয়ে নিঃশব্দে মরতে থাকা শিশু।”
এমন নির্মম ও বাস্তব চিত্র সাহিত্যে আনতে সাহস লাগে। তিনি সেই সাহস দেখিয়েছিলেন অকপটে। কবিতায় তিনি কোনও সৌন্দর্যচর্চায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি, বরং কবিতাকে করেছেন জাগরণের হাতিয়ার।
সুকান্ত শুধুই রাজনৈতিক কবি নন, তিনি ছিলেন মানবিক বোধে পরিপূর্ণ একজন লেখক। শিশুদের জন্য তিনি লিখেছেন হৃদয়ছোঁয়া কবিতা ও ছড়া। যেমন তাঁর জনপ্রিয় কবিতা ‘আঠারো বছর বয়স’–এ তিনি শিশুর মতো অবুঝ নয়, বরং বলিষ্ঠ কণ্ঠে সমাজকে প্রশ্ন করেন। একইসঙ্গে তিনি লিখেছেন শিশুদের কল্পনার জগৎ নিয়েও। মাত্র ২১ বছর বয়সে, ১৯৪৭ সালের ১৩ মে, সুকান্ত যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এই অকালপ্রয়াণ বাংলা সাহিত্যকে এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন করে। তবে তাঁর রেখে যাওয়া সাহিত্যিক সম্পদ আজও আমাদের আলো দেখায়, আমাদের জাগায়, প্রতিবাদ করতে শেখায়। সুকান্তের কবিতা আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ সমাজে এখনও রয়েছে দারিদ্র্য, বৈষম্য, শোষণ, এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রয়োজন। যখন কোনও শিশু না খেয়ে ঘুমায়, কিংবা কোনও শ্রমিক তার ন্যায্য মজুরি পায় না, তখন মনে পড়ে যায় সুকান্তের সেই পঙক্তি–
“রাতে এখনও ভাত জোটে না অনেক ঘরে,
তখন সুকান্তের কবিতা চিৎকার করে উঠে।”
সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন সুকান্ত। তিনি বিশ্বাস করতেন-“কবিতা শুধু ফুল আর ভালোবাসার কথা বলবে না, কবিতা বলবে রক্ত আর ঘামের কথা, বলবে সংগ্রামের কথা।” আমাদের উচিত তাঁর সেই স্বপ্ন ও সংগ্রামের বার্তা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তাঁকে নতুন করে পাঠ করা, নতুনভাবে উপলব্ধি করাই হতে পারে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।