প্রবারণা পূর্ণিমা : বিভাজিত সমাজে সংহতির বার্তা

উজ্জ্বল মুৎসুদ্দী সম্পু | সোমবার , ৬ অক্টোবর, ২০২৫ at ৫:১৭ পূর্বাহ্ণ

শরতের শুভ্র, সমুজ্জ্বল নীলাকাশে যখন পূর্ণিমার চাঁদ ভেসে ওঠে, তখন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে জ্বলে উঠে মঙ্গলপ্রদীপ, উড়ে যায় নানান রঙের ফানুস। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর প্রতীকী শপথপ্রবারণা পূর্ণিমা। এ উৎসবকে বলা হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আধ্যাত্মিক বর্ষাবাস সমাপনের দিবস। তবে এর তাৎপর্য কেবল ধর্মীয় উৎসবে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এক গভীর মানবিক ও সামাজিক দর্শনের অনুপম প্রকাশ যা আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতেও গভীর প্রাসঙ্গিক। আর বর্তমান বাংলাদেশে, যেখানে বিভাজন, অসহিষ্ণুতা আর পারস্পরিক অবিশ্বাস ক্রমেই সামাজিক জীবনে প্রবল হচ্ছে, সেখানে প্রবারণা পূর্ণিমার শিক্ষা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।

বর্ষাবাস থেকে লব্ধ হয় মানবিকতার পাঠ। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বর্ষাকালে তিনমাস ভ্রমণ পরিহার করে নির্দিষ্ট স্থানে অর্থাৎ স্ব স্ব ধর্মায়তনে অবস্থান করে শীলসমাধিপ্রজ্ঞা তথা আত্মশুদ্ধি, সংযম, শিক্ষা ও ধ্যানে মনোনিবেশ করেন। এই বর্ষাবাস শেষে আশ্বিনী পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয় প্রবারণা। যার অন্তর্নিহিত প্রকাশ প্রকৃষ্টরূপে বারণ ও বরণ। এদিন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রকাশ্যে একে অপরের কাছে নিজেদের ভুল স্বীকার করেন এবং অপরের অপরাধ ও ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ধর্মীয় জীবনে এমন উন্মুক্ত স্বীকারোক্তি এক অনন্য উদাহরণ, যা পরবর্তীকালে সমাজ ও সংস্কৃতির নানা স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এ দৃশ্য আমাদের শেখায়যাপিত জীবনে আমাদের ভুল হয়ই, কিন্তু সেটি স্বীকার করার সাহসই হলো মানবের প্রকৃত শক্তি। সামাজিক জীবনে ভুলভ্রান্তি অনিবার্য; কিন্তু স্বীকার করতে না পারা, কিংবা ক্ষমা না করতে না পারাই অধিকতর সংকট সৃষ্টি করে। প্রবারণা পূর্ণিমা এই সংকট নিরসনের পথ দেখায়। আজকের সমাজে ভুল স্বীকার করা দুর্বলতা মনে করা হয় অথচ ক্ষমা চাইতে পারা এবং ক্ষমা করতে জানা হলো মানবিকতার প্রকৃত সৌন্দর্য।

এই ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস শেষে প্রবারণায় তথাগত সম্যকসম্বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্যে প্রজ্ঞাপন দিয়েছিলেন-“চরতো ভিক্‌খবে চারিকং, বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়।” এটি কোনো নির্দিষ্ট এলাকা, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা মানবজাতির জন্য নয়, বরং সমগ্র ভূমন্ডলের সকল সত্তার হিতার্থে নিজেকে নিবেদন করার জন্য কল্যাণসুন্দর নির্দেশনা। যে আদর্শ মানুষকে সকল সংকীর্ণতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের শিখরে আরোহণ করতে অনুপ্রাণিত করে, সে আদর্শে মহামতি বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে তথা মানবজাতিকে পথ চলতে প্রজ্ঞাপ্ত করেছেন।

ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বিপরীতে সামষ্টিকতার যে অনুষঙ্গ সেটাকেই উপজীব্য করে কঠিন চীবর দানোৎসবকে তিনি মহিমান্বিত করেছেন। প্রবারণা মূলত মানুষকে আমন্ত্রণ জানায় এক অন্তর্দীপ প্রজ্জ্বলনের পথে। দৃশ্যমান প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, বা ফানুস উড্ডয়ন কেবল প্রতীক মাত্রপ্রকৃত প্রদীপ জ্বলে মানবের অন্তর্লোকে। নিজেকে দহনের মাধ্যমে জগতে আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরণে প্রদীপের যে আদর্শ সে আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন ‘অত্তদীপ বিহরতি’। নিজেই নিজের প্রদীপ হয়ে বিকশিত হও, নিজের মুক্তির পথ নিজেই অন্বেষণ কর। এ উৎসব মনে করিয়ে দেয়, মানুষ যতই প্রযুক্তিতে উন্নত হোক, যদি অন্তর্লোকের অহংকার, বিদ্বেষ, লোভ ও কলুষ দূর না হয়, তবে জীবনে শান্তি আসবে না।

গৌতম বুদ্ধ আরও বলেছিলেনযুদ্ধে সহস্র ব্যক্তিকে জয়লাভ করার চেয়ে নিজেকে জয় করাই সবচেয়ে বড় বিজয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজ বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে