সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

| সোমবার , ৬ অক্টোবর, ২০২৫ at ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ

নিত্যনতুন উদ্ভাবন, প্রযুক্তির নানামুখী ব্যবহার ও চিন্তাচেতনায় আমরা অনেক বেশি অগ্রসর। প্রযুক্তির বড় উপকরণ ইন্টারনেটের আওতায় এদেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী চলে এসেছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অধিকাংশ ব্যক্তি সক্রিয় আছেন। আমরা জানি, ইমেইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ভাইবার, লিংকডইন জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম। এদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফেসবুক। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির যোগাযোগ বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকাকে অস্বীকার করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সামাজিক মাধ্যমের অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তাইএর প্রমাণ। কিন্তু তার পাশাপাশি দেশে সাইবার ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সাইবার সহিংসতার শিকার হওয়াদের মধ্যে ৯৭ শতাংশই নারী ও শিশু। ‘সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন প্ল্যাটফর্ম’এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সারা দেশে ঘটে যাওয়া নারী ও শিশুর প্রতি সাইবার সহিংসতার ২৯টি ঘটনা বিশ্লেষণ করে প্ল্যাটফর্মটি এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এসব ঘটনা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রকাশ করেছে।

সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন প্ল্যাটফর্ম অনলাইনে সংঘটিত নারী ও শিশু সহিংসতার প্রতিকার ও প্রতিরোধে সম্মিলিতভাবে কাজ করে আসছে। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) উদ্যোগে গঠিত এই প্ল্যাটফর্মে ব্র্যাক, নারীপক্ষ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনসহ (সিক্যাফ) মোট ১৪টি সংগঠন রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে সাইবার সহিংসতার শিকার হওয়াদের মধ্যে ৪১ দশমিক ৩ শতাংশই শিক্ষার্থী। গৃহিণী ২০ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া বিক্রয়কর্মী, বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কর্মী ও ব্যবসায়ী ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি ইঙ্গিত করে, সামাজিকভাবে তুলনামূলক দুর্বল গোষ্ঠীই অনলাইন সহিংসতার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বাকি ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভুক্তভোগীর পেশা জানা যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে এপ্রিল মাসে সবচেয়ে বেশি ১০টি নারী ও শিশু সাইবার সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে আর মার্চে ঘটেছে ৯টি। এই দুই মাসে মোট ঘটনার ৬৫ শতাংশের বেশি ঘটনা ঘটেছে। অঞ্চল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ১৩টি ঘটনা ঘটেছে ঢাকা শহরে। রাজধানী হিসেবে ঢাকা ডিজিটাল অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৬ শতাংশ নারী, ২১ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যাশিশু আর ৩ শতাংশ পুরুষ।

সহিংসতার ধরন তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, নারী ও শিশুদের নিয়ে ছড়ানো সাইবার সহিংসতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্ল্যাকমেল, ধর্ষণ, পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট ছড়ানো এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে নগ্ন ছবি তৈরি করে ব্ল্যাকমেল করার মতো ঘটনা রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেল করার ঘটনাও ঘটেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অধিকাংশ ঘটনার মধ্যে একাধিক ধরনের নির্যাতনের উপস্থিতি ছিল। ৭০ শতাংশের বেশি ঘটনায় একই সঙ্গে ধর্ষণ, ভিডিও ধারণ, ব্ল্যাকমেল ও ডিজিটাল কনটেন্ট ছড়ানোর মতো অপরাধ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ে জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একটি জরিপের কথা। ২০২১ সালের সেই জরিপে উঠে এসেছে ইন্টারনেট আসক্তির চিত্র। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭৬.১ শতাংশ ভিডিও দেখেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকেন ৫৫.৯ শতাংশ, গেমিংয়ে সময় ব্যয় করেন ৫৪.৫ শতাংশ। ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন ৭৯.৪ শতাংশ, ল্যাপটপ ৩.৯ শতাংশ, মোবাইল ৪.৫ শতাংশ, ডেস্কটপ ২.৮ শতাংশ এবং অন্যান্য মাধ্যমে ৪৮.৭ শতাংশ। ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১০ থেকে ১৪ বছরের শিশুর সংখ্যা ১০.৮ শতাংশ, ১৫ থেকে ২৫ বছরের মানুষের সংখ্য ২৬ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ফেসবুকে অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে অনেকে এটিকে অপব্যবহার করছে অথবা হীন কোনও উদ্দেশ্যে বা তার ব্যক্তিগত কোনও উদ্দেশ্যে অথবা রাজনৈতিক কোনও উদ্দেশ্যে ফেসবুকের যে উপাদানগুলো রয়েছে সেসব উপাদানগুলোকে ব্যবহার করছে। সমস্যাটি তৈরি হচ্ছে এখান থেকেই। পরিচয় নিশ্চিত করা গেলে ব্যবহারকারী নিজেই নিজের কাজে লাগাম টানবে। কোনও কিছু করার আগে অন্তত কিছুটা হলেও তার মধ্যে চিন্তা কাজ করবে। তাছাড়া একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা কিংবা প্রক্রিয়া অথবা শিষ্টাচারের মধ্যে নিয়ে আসা হলে ইতিবাচকতার সংখ্যা এবং ইতিবাচকভাবে ফেসবুক ব্যবহার করার প্রবণতাও বেড়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমাজে নারীদের ডিজিটাল নিরাপত্তা এখন আর বিলাসিতা নয়, এটি একটি জরুরি অধিকার। এআই প্রযুক্তি যেমন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে, তেমনি তা অপরাধীদের জন্য এক ভয়ংকর অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকার, সামাজিক সংগঠন ও প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে সাইবার এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে