আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে কার্যকর হতে যাওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের বর্ধিত নতুন ট্যারিফ নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে লিখিতভাবে আপত্তি জানানো হয়েছে। রাতারাতি কার্যকরের উদ্যোগ এবং পরবর্তীতে এক মাস স্থগিত রেখে আবার ট্যারিফ আরোপে দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বহু গুণ বৃদ্ধি করা ট্যারিফের ফলে বিদেশি জাহাজ মালিকেরা চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ পাঠানো বন্ধ করে বিকল্প বন্দরের খোঁজ করবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ব্যবহারকারীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে ৪শ শতাংশ এবং সার্বিকভাবে ৭০ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া ৬ মাস থেকে এক বছরের নোটিশ প্রদানের মাধ্যমে বর্ধিত ট্যারিফ কার্যকরের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি জানিয়ে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে গতকাল পত্র দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন সেবা খাতে ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে, ১৯৮৬ সালের পর এই ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হলো। বন্দর পরিচালনার সার্বিক খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ট্যারিফ বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলেও বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে ট্যারিফ বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে তা কার্যকর করার কথা বলা হয়েছিল। ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বন্দরের বিভিন্ন সেবাখাতে সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ পর্যন্ত ট্যারিফ বাড়ানো হয় বলে জানানো হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বন্দর ব্যবহারকারীদের আপত্তির মুখে ট্যারিফ বৃদ্ধি এক মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে নতুন ট্যারিফ কার্যকর করার বিষয়ে ইতোমধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ নোটিশ প্রদান করেছে।
১৫ অক্টোবর থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষের বর্ধিত ট্যারিফ আদায়ের ঘোষণার প্রেক্ষিতে বন্দর ব্যবহারকারীরা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। বর্ধিত ট্যারিফ অন্তত এক বছরের জন্য স্থগিত রাখার দাবি জানিয়ে আসছেন তারা।
চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম ব্যবহারকারী শিপিং এজেন্টদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে গতকাল নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবরে একটি জরুরি পত্র দিয়ে নিজেদের গভীর উদ্বেগের কথা জানায়। ব্যবহারকারীরা ট্যারিফ বৃদ্ধির হারকে নজিরবিহীন এবং অযৌক্তিক আখ্যায়িত করে এতে ব্যবসা–বাণিজ্য মারাত্মক ঝুঁকির মাঝে পড়বে বলে উল্লেখ করে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি জাহাজের জন্য টাগ ভাড়া ২,৯০৭.২০ মার্কিন ডলার (১৫% ভ্যাটসহ)। কিন্তু নতুন ট্যারিফে একই সেবার ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫,৭০৯ ডলার; যা পূর্বের তুলনায় ৪৪০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি। শুধু তাই নয়, সামগ্রিকভাবে প্রায় ৭০ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হয়েছে উল্লেখ করে তারা বলেন, এতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
ব্যবহারকারীরা বলেছেন, ১৯৮৬ সালের চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফে ৬০টি সেবাখাতের মধ্যে ২৫টি ডলারভিত্তিক। ওই সময় প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৩০–৩২ টাকা, যা বর্তমানে ১২০ টাকার বেশি। এতে করে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ট্যারিফ বেড়ে গেছে।
ট্যারিফ কার্যকরের জন্য মাত্র এক মাস সময় দেয়াকে অপর্যাপ্ত মন্তব্য করে ব্যবহারকারীরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক শিপিং চুক্তি ও বাজেট কয়েক মাস বা বছরখানেক আগেই নির্ধারিত হয়। ফলে অন্তত ৬ থেকে ১২ মাসের পূর্ব নোটিশ ছাড়া এত বড় পরিবর্তন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হঠাৎ ও উচ্চমাত্রার ট্যারিফ আরোপ এবং পরিবর্তনে ব্যবসা–বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তারা বলেন, এতে বিদেশি জাহাজ মালিকেরা অন্য বন্দর ব্যবহার করবেন। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ কমে যাওয়ার পাশাপাশি আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে পণ্য পরিবহন ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেশীয় ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবেন। বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যাহত হলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রেও সংকট তৈরি হবে, যা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ইতোমধ্যে বিদেশি জাহাজ মালিকেরা নতুন ট্যারিফের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছেন বলে চিঠিতে জানানো হয়েছে। বন্দর ব্যবহারকারীরা ট্যারিফ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, কমপক্ষে ৬ মাস থেকে এক বছরের নোটিশ দিয়ে ধাপে ধাপে নতুন ট্যারিফ চালু করা হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য নিশ্চিত করবে। যা দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যসহ সার্বিক ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনবে। সংগঠনের পক্ষ থেকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং বন্দর চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিষয়টি যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, জাতীয় স্বার্থ, রপ্তানি সক্ষমতা এবং বিদেশি বাণিজ্যের স্থিতিশীলতার জন্য এর একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান জরুরি।
গতকাল এই চিঠি মন্ত্রণালয় এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবরে পৌঁছানো হয়েছে। গত রাত পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ট্যারিফ এক মাস স্থগিত করা হয়েছিল। আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে নতুন ট্যারিফ আদায় হবে। এতে আর কোনো পরিবর্তনের সুযোগ নেই।