হিসাবের সমীকরণ মিলে না

নাসের রহমান | শনিবার , ৪ অক্টোবর, ২০২৫ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

এখন আর হিসাব মিলে না। কোনো কিছুতেই হিসাব মিলে না। ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন কোথাও হিসাবের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার গ্রামীণ জীবন, শহরের জীবন, নাগরিক জীবন সেখানেও হিসাবের কোনো মিল নেই। কেউ কোনো হিসাব মিলাতে পারে না। দৈনন্দিন হিসাব, মাসিক হিসাব, আয়ব্যয়ের হিসাব। কোনোটাই মেলানো যায় না। ছেলে মেয়ের হিসাব, স্বামী স্ত্রীর হিসাব, বৃদ্ধ বাবা মার হিসাব, সাংসারিক হিসাব। কোথাও মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সেখানেও হিসাবের মিল নেই। শিশু কিশোর তরুণ তরুণীরাও হিসাব মেলাতে পারে না। নারী পুরুষ প্রৌঢ় বৃদ্ধ কেউ আর হিসাব করতে পারে না। সবকিছু যেন হিসাবের বাইরে চলে। হিসাবের সমীকরণ আর কখনো মিলে না।

হিসাব যেন অনিয়মে চলে। অনিয়মই নিয়ম এখন। অফিস আদালত কোর্ট কাচারি অনিয়মে চলে। ব্যাংক বীমা ব্যবসা বাণিজ্য কোথাও নিয়ম নেই। শিল্প কলকারখানা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি সবখানে অনিয়ম। পোর্ট কাস্টমস বিভিন্ন সংস্থা কোথায় অনিয়ম নেই। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মাঝারী ব্যবসায়ী বড় ব্যবসায়ী কেউ নিয়ম মেনে চলে না। বড় উদ্যোক্তা বড় ব্যবসায়ী বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বড় ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। সবাই বড় হতে চায়। ছোট বা মাঝারী কেউ থাকতে চায় না। এটাই স্বাভাবিক। তবে বেশির ভাগ মানুষ মাঝারি থাকতে চায়। যাদেরকে মধ্যবিত্ত বলা হয়ে থাকে। এ মধ্যবিত্তরাই আয় ব্যয়ের হিসাব মেলাতে চায়। নিয়মের মধ্যে থাকতে চায়। নিয়মের মাঝে থেকে এগিয়ে চলতে চায়। নিয়মের বেড়াজালে তারা বেশি হয়রানির শিকার হয়। তারপরও নিয়ম মেনে চলতে চায়।

স্কুল কলেজ মাদ্রাসা কোথাও নিয়ম শিখানো হয় না। নিয়ম মেনে চলার কথা বলা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়েও নিয়মের ধার ধারে না। নিয়ম অনিয়মের শিক্ষার প্রতি কারো তেমন আগ্রহ নেই। অনেকে মুখে বললেও কার্যক্ষেত্রে এর কোনো প্রয়োগ নেই। অনিয়মের সাথে যে দুর্নীতি সরাসরি জড়িত এ বাস্তবতা অনুধাবন করার মানসিকতা দেখা যায় না। ন্যায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। বিশেষ করে শিক্ষকদের। সে দায়িত্ব কতটুকু পালন করা হয়। নানা ধরনের অনিয়ম ও সমস্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জর্জরিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানুষ গড়ার কারখানা। আর শিক্ষকরা হলো মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় গলদ, বড় অনিয়ম, সমন্বয়হীনতা। যার প্রভাব শিশু কিশোর তরুণ শিক্ষার্থীর ওপর গিয়ে পড়ে।

স্বাস্থ্য সেবা, নামেই সেবা। কার্যত সেবা কোথায়? চিকিৎসা সেবার নামে ভোগান্তির শেষ নেই। স্তরে স্তরে অনিয়ম। নিয়মের কোনো বালাই নেই। খেয়াল খুশিমত বিচরণ সবার। কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। মজ্জাগত দুর্নীতি। অনিয়ম আর দুর্নীতির মহা উৎসব চলে। দেখার কেউ নেই। সবাই যেন একই সূত্রে গাঁথা। চিকিৎসা পেতে হলে এসবের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। নিয়মের ভেতর দিয়ে নয়, অনিয়মের সাথে আপষ করতে হয়। তারপরও পদে পদে হয়রানি। অভিযোগ শোনার কেউ নেই। শোনেও কিছু করতে পারে না। কেউ কারো কথা শোনে না। যে যার মতো করে চলে। অবহেলায় অযত্নে চিকিৎসা সেবা ঘুরপাক খায়। সাধারণ মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। গরিব দুঃখি হত দরিদ্র নিঃস্বরা চিকিৎসা পায় না।

রাস্তা ঘাটে কেউ নিয়ম মেনে চলে না। যানবাহন চলাচলে যেন কোনো নিয়ম নেই। কার আগে কে যাবে সে চেষ্টায় থাকে। ছোট মাঝারি বড় সবধরনের যানবাহন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করে না। ইচ্ছা মতো চালাতে থাকে। রাইট সাইড রং সাইড বলে কিছু নেই। যেখানে সেখানে জ্যাম লাগিয়ে দেয়। মোড়ে মোড়ে যানজট লেগে থাকে। মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। কত ঘণ্টা নষ্ট হয়ে যায় তার হিসাব থাকে না। ট্রাফিকের সিগন্যাল যেখানে সেখানে যানজট। ট্রাফিক আইন কেউ মানতে চায় না। ট্রাফিক ব্যবস্থায়ও নানা ধরনের ত্রুটি বিচ্যুতি। অনিয়ম অদক্ষতা অব্যবস্থাপনা এখানেও ভর করে আছে। দূরপাল্লার যানবাহনগুলো এতোই বেরপরোয়া চলে কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না। হতাহতের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটে। এতো প্রাণহানি হয় তাতেও কারো বোধোদয় হয় না। সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এসব দুর্ঘটনার সুষ্ঠু কোনো তদন্ত হয় না। এসব ক্ষেত্রেও অনিয়মের মধ্য দিয়ে সুরাহার পথ খোঁজা হয়।

এখন কেউ কাউকে মানে না। কেউ কারো কথা শুনতে চায় না। শোনার প্রয়োজনও মনে করে না। ছোটদের কথা বড়রা শুনতে চায় না। আবার ছোটরা বড়দের মানে না। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কথা কানে নেয় না। শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকদের মানতে চায় না। ঘরে বাইরে সমাজে কোথাও মানামানির বিষয়টা তেমন আর গুরুত্ব পায় না। এমনকি অফিস আদালতেও কেউ কাউকে মানতে চায় না। যদিওবা এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিধি বিধান রয়েছে। যার তেমন একটা প্রয়োগ দেখা যায় না। কাউকে ভয় ভীতি দেখানোর জন্য কিংবা অপদস্থ করার জন্য মাঝে মধ্যে এসব বিধি বিধানের প্রয়োগের কথা শোনা যায়। বস্তুত পারস্পরিক সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধের যে মানসিকতা তা এখন আর নেই বললে চলে। অন্যের প্রতি সম্মান দেখানোর চেয়ে অসম্মান করাটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে।

সময়ের সাথে অনেক কিছু বদলে যায়। বিষয় আশয়েরও পরিবর্তন হয়। আশা আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তন হয়। মন মানসিকতাও অন্যরকম হয়ে যায়। সংস্কৃতিতেও ভিন্ন রূপ পরিলক্ষিত হয়। আন্দোলন সংগ্রাম আর শেষ হয় না। গণ অভ্যুত্থান হয়, ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান ঘটে। সরকার আসে সরকার যায়। শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন হয় না। আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে না। সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয় না। বৈষম্যের অবসান ঘটে না। অন্যায় অবিচার সমান তালে চলে। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হয় না। অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। কিশোররা অপরাধ চক্রে জড়িয়ে পড়ে। তরুণরা ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। সঠিক পথ নির্ধারণ করতে পারে না। মুক্তির পথ খুঁজে পায় না। একেক ধরনের বয়ান বা নেরেটিভের মধ্যে সবাই ঘুরপাক খায়। বয়ানের পর বয়ান চলতে থাকে। সময় আর থেমে থাকে না। নবীনেরা আর নবীন থাকে না, তরুণরাও। একসময়ে নবীনেরা প্রবীণ হয়ে যায়। কিন্তু কেউ আর হিসাব মিলাতে পারে না। কী তরুণ, কী যুবক, কী নবীন, কী প্রবীণ। কারো হিসাব মিলে না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধরাউজানে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত চার পরিবারের মাঝে যুবদল নেতার নগদ অর্থ ও বস্ত্র বিতরণ