গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহরের বাকি থাকা জাহাজটিও ভূমধ্যসাগরে আটকেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গতকাল শুক্রবার সকালে ইসরায়েলি কমান্ডোরা নৌযানটি আটক করে। পোল্যান্ডের পতাকাবাহী ‘ম্যারিনেট’ জাহাজটি ছিল ৪৪টি নৌযানের শক্তিশালী ফ্লোটিলা বহরের সবশেষ জাহাজ যা গাজার দিকে ছুটে যাচ্ছিল।
এদিকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেছেন ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ থেকে আটক হওয়া ব্যক্তিরা। ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি টু ব্রেক দ্য সিজ অব গাজা’ গতকাল এ কর্মসূচির কথা জানিয়েছে।
জানা যায়, শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গাজা থেকে ৪২ দশমিক ৫ নটিকাল মাইল দূরে ম্যারিনেটকে আটকায় ইসরায়েলি বাহিনী। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েল বহরের বাকি সব নৌযানকে আটকায় এবং সেখানে থাকা বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারকর্মী ও ক্রুদের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যায়। সেখানে আটক মানবাধিকারকর্মী ও ক্রুদের বিষয়ে যাচাই–বাছাই শেষে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম শুরু হবে।
আটক মানবাধিকারকর্মীরা অনশনে : গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙার লক্ষে গঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি টু ব্রেক দ্য সিজ অব গাজা’ বলছে, আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার মুহূর্ত থেকে তারা অনশন কর্মসূচি শুরু করেন।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি অভিযানে ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। জাতিসংঘের পাশাপাশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বারবার সতর্ক করে আসছে, গাজা উপত্যকা ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে এবং সেখানে দুর্ভিক্ষ ও রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে গাজায় ত্রাণ পৌঁছে দিতে গত ৩১ অগাস্ট স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। এ নৌবহরে প্রায় ৫০টি জাহাজ ছিল। এসব জাহাজে অধিকারকর্মীসহ প্রায় ৪৪টি দেশের সাড়ে চারশ প্রতিনিধি ছিলেন। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার সবগুলো জাহাজ ইসরায়েল আটক করেছে। গ্রেপ্তার করেছে এসব জাহাজে থাকা ব্যক্তিদের। সবগুলো জাহাজই আটক করা হয় আন্তর্জাতিক জলসীমা ও ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক জলসীমা থেকে।
দেশে দেশে বিক্ষোভ : গাজায় ত্রাণ বহনকারী নৌবহরে হামলার ঘটনায় বিভিন্ন দেশে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে অনেক দেশ উদ্বেগ জানিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাধা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ভলকার টুর্ক ইসরায়েলকে ‘দ্রুত গাজার অবরোধ তুলে নিতে এবং সব সম্ভাব্য সব উপায়ে জীবন রক্ষাকারী উপকরণের প্রবেশাধিকার দেওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, তারা নৌকায় থাকা ব্রিটিশ নাগরিকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে যে ‘আমরা আশা করি পরিস্থিতি নিরাপদভাবে সমাধান হবে’। আইরিশ ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস এই প্রতিবেদনগুলোকে ‘উদ্বেগজনক’ বলেছেন এবং জানিয়েছেন, তিনি আশা করেন ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলবে।
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো তার দেশে থাকা সব ইসরায়েলি কূটনীতিককে দেশ থেকে বহিষ্কার করেছেন। তিনি এই বাধা দেওয়াকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন ‘নেতানিয়াহুর আন্তর্জাতিক অপরাধ’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধ ‘অবৈধ’ এবং ‘বহু দশক ধরে ইসরায়েল যেভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায়মুক্তি পাচ্ছে তার শেষ হতে হবে।’
সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে শত শত মানুষকে আটকের ঘটনার পর প্রতিবাদে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ফিলিস্তিনিপন্থি বিক্ষোভকারীরা পথে নেমে আসেন। নিন্দা জানাতে ডাবলিন, প্যারিস, বার্লিন এবং জেনেভার রাস্তায় হাজার হাজার বিক্ষোভকারী সমবেত হন। বুয়েনস আইরেস, মেঙিকো সিটি এবং করাচিতেও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ইতালির ইউনিয়নগুলো শুক্রবার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে এবং দেশটিতে ১০০রও বেশি মিছিল বা গণসমাবেশের সম্ভাবনা রয়েছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি অবশ্য গাজায় পৌঁছানোর প্রচেষ্টাকে সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি এখনো বিশ্বাস করি, এসব কিছুই ফিলিস্তিনি জনগণের কোনো উপকারে আসে না।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তায়েপ এরদোয়ান ইসরায়েলি আগ্রাসনের সমালোচনা করে বলেছেন, এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে ইসরায়েল সরকারের শান্তির আশা তৈরি হতে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা অবিলম্বে নৌবহরে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকানদের মুক্তি দেয়, যার মধ্যে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি নকোসি জুয়েলেভেলিল ম্যান্ডেলাও রয়েছেন। গাজাগামী ত্রাণবহর আটকের পর স্পেন ইসরায়েলি চার্জ ডি’অ্যাফেয়ার্সকে তলব করেছে। স্টেডফাস্টনেস ফ্লোটিলা জাহাজে থাকা সাত বেলজিয়ান নাগরিককে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বেলজিয়াম ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকেও তলব করেছে।
পাকিস্তান, বলিভিয়া এবং মালয়েশিয়াও ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রেও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখা গেছে।