আল কুরআনে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অনুসরনের নির্দেশনা:
আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ সত্যান্বেষী মুক্তিকামী মানুষের পথ প্রদর্শক। তাদের অনুসৃত পথে ও পদাঙ্ক অনুসরনে দিকভ্রান্ত মানুষেরা সঠিক পথের দিশা পাবে। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, যে আমার দিকে ফিরেছে তুমি তার অনুসরণ করো। (সূরা: লোকমান, আয়াত: ২৫)
বর্ণিত আয়াতে করীমার ব্যাখ্যায় তাফসীরে জালালাইন শরীফে উল্লেখ রয়েছে, যে আমার আনুগত্য করে আমার পথে ফিরেছে তুমি তার পথ ধরো। (তাফসীর জালালাইন, পৃ: ৩৪৭)
আল্লাহ ফেরেস্তাদের মজলিসে প্রিয় বান্দাদের আলোচনা করেন:
যাদের জীবন কর্ম ‘আল্লাহর ধ্যানে স্মরনে সর্বদা নিয়োজিত’ সর্বাবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই যাদের কাম্য তাঁদের মর্যাদা প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা ও হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যারা আল্লাহর জিকিরে থাকে ফেরেস্তারা তাঁদের চারপাশ ঘিরে রাখে, রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, তাদের উপর শান্তি অবতীর্ন হতে থাকে আল্লাহ তা’আলা (ফেরেস্তাদের মজলিসে) তাঁদের আলোচনা করেন।(মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী, আততারগীব ওয়াততারহিব, খন্ড:২, পৃ: ৪০৬)
হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (র.)’র পরিচিতি নাম ও জন্ম:
তাঁর নাম: আবদুল কাদের , তাঁর উপনাম: আবু মুহাম্মদ, পিতা: সায়্যিদ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত, মাতা: উম্মুল খায়র ফাতেমা, পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয়ধারায় ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের বংশধারায় আউলাদে রাসুল। এ কারণে তাঁকে আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী বলা হয়। হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (র.) ১ রমজান ৪৭০ অথবা ৪৭১ হিজরি মোতাবেক ১৮ মার্চ ১০৭৭ অথবা ১০৭৮ খ্রি. ইরাকের জিলান শহরে নিফ নামক শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। গীলান হচ্ছে গাউসে পাকের জন্মস্থান, আরবিতে “গাফ” কে “জীম” বর্ণ দ্বারা পরিবর্তন করে জীলান উচ্চারণ করা হয়। গীলান শহরের দিকে সম্পৃক্ত করে তাঁকে জিলানী, গিলানি, কিলানি, ইত্যাদি বলা হয়। কেউ কেউ জিলানি কে জিলি বলেছেন। (বাহজাতুল আসরার, পৃ: ৮৮)
উপাধি: মুহিউিদি্দন “শায়খুল মাশায়েখ, শায়খুল ইসলাম, গাউসুল আজম, তাজুল আরিফিন, কুতুবে বাগদাদ কুতুবুল আকতাবসহ বহু উপাধিতে তিনি ভূষিত হয়েছেন।
জ্ঞানার্জন: শায়খ জিলানী ১৮ বছর বয়সে ৪৮৮ হিজরিতে জিলান ছেড়ে ইলমে দ্বীন অর্জনের অদম্য আকাঙ্খা নিয়ে বাগদাদে আসেন। তিনি ইলম অর্জনে সুদীর্ঘ ৩২ বছর ব্যয় করেন, এর পর ৫২০ হিজরিতে শিক্ষাদান ও ওয়াজ নসীহতের ও তাবলীগে দ্বীনের মহান কাজের সূচনা করেন। (তাবকাতুল হানাবিলা ১/২৯০)
তিনি ছিলেন প্রাজ্ঞ আলেম, সমকালের শ্রেষ্ঠ ইসলামি ব্যক্তিত্ব উচ্চ মর্যাদার অধিকারী, দ্বীনের সংশোধনকারী। আল্লামা হাফিজ যাহাবি (র.) তাঁকে শায়খুল ইসলাম উপাধি দিয়েছেন, ইমাম ইবনু রজব হাম্বলি (র.) তাঁকে হাম্বলি মাযহাবের ইমাম বলে অভিহিত করেছেন। (শায়খ আবদুল কাদের জিলানি, ড. সায়্যিদ কাহতানি: ২৮)
গাউসে পাকের শিক্ষকমণ্ডলি:
জাহেরি ও বাতেনী ইলমে সমৃদ্ধ যুগশ্রেষ্ঠ তাফসিরকার ও হাদীস বিশারদগণের সান্নিধ্যে হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) ইলমে দ্বীন অর্জন করেন। যেমন তাঁর ইলমে হাদীসের ওস্তাদ ছিলেন আবু গালিব মুহাম্মদ ইবন হাসান আল বাকিল্লানী, হযরত আবু বকর আহমদ ইবনুল মুযাফফর, হযরত আবুল কাসিম আলী ইবনে বাফান আর রাযযাব, ইলমে ফিকহর ওস্তাদ ছিলেন, হাম্বলী মাযহাবের শায়েখ আবুল ওয়াফা আলী ইবন আকীল, হযরত আবুল খাত্তাব মাহফুজ, হযরত কাযী আবু সাদ মুবারক ইবন আলী মুখাররিমি, হযরত আবুল হাছান মুহাম্মদ ইবনুল কাজী আবু ইয়ালা আলা ফারবী হাম্বলী, গাউসে পাক (র.) চার মাযহাবের ফিকহর আলোকে ফতোয়া প্রদানে দক্ষ ও পারদর্শী ছিলেন। (গিবতাতুন নাযির ফি তরজমাতিশ শায়খ আবদিল কাদির ‘ইমাম ইবন হাজর আসকালানী (র.) গউসে পাকের ওস্তাদ হযরত কাজী আবু সাঈদ মোবারক (র.) তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন বলতেন হে আবদুল কাদির! সে সময় অতি নিকটবর্তী যখন তোমার নাম ও খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। তুমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বীনকে পুনর্জীবিত করবে। সমগ্র পৃথিবীর লোকেরা তোমার ইলম দ্বারা উপকৃত হবে।
ওয়াজ নসীহত: হযরত শায়খ জিলানী (রহ.)’র ছেলে হযরত শায়খ আবদুল ওয়াহাব (র.) বর্ণনা করেন, আমার আব্বাজান শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (র.) সপ্তাহে তিন দিন ওয়াজ নসীহত করতেন, তাঁর ওয়াজের মাহফিলে সত্তর হাজারের অধিক লোক সমবেত হতো। তাঁর মূল্যবান নুরানী তকরীরগুলো লিখে রাখার জন্য চারশত জন লিখক খাতা কলম নিয়ে প্রস্তুত থাকতেন, তারা তকরীর লিখে রাখতেন। তিনি তকরীর করতেন শুক্রবার ফজরের নামাযের পর, মঙ্গলবার রাত্রে, নিজ মাদরাসায় বুধবার ফজরের নামযের পর মেহমান আপ্যায়ন করতেন। কুরআন ও হাদীসের আলোকে তাঁর হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী তকরীর শ্রবণ করে উপস্থিত লোকেরা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতো, হাজার হাজার কাফির ইহুদী খ্রিস্টান তাঁর তকরীর ও নসীহা শ্রবণ করে ইসলাম গ্রহণ করে নিজেদেরকে ধন্য করেন। লক্ষাধিক লোক তাঁর হাতে তাওবা করে অন্তরাত্নাকে আলোকিত করেন। ১৩টি ভাষায় তার দক্ষতা ছিল ১৩ ভাষাতে তিনি তকরীর করতে পারদর্শী ছিলেন। হাজার হাজার আউলিয়ায়ে কিরাম ও ফিরিস্তাগণ শায়খের মজলিসে উপস্থিত থাকতেন। [গাওসুল ওয়ারা, শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (র.)]
কারামাত:
হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (র.) কাশফ ও কারামাতের অধিকারী ছিলেন। তাঁর অসংখ্য কারামত পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লিখিত কিতাব সমূহে লিপিবদ্ধ হয়েছে, সংক্ষেপে কয়েকটি কারামত উপস্থাপন করলাম।
হযরত ইমাম আবুল হাসান আলী শাতনূফী বলেন, একবার গাউসে পাকের দরবারে তের জন খ্রিস্টান আগমন করে তারা গাউসে পাকের ওয়াজের মজলিসে অংশ গ্রহণ করে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তারা বললেন, আমরা মরক্কোর খ্রিস্টান। আমরা সবাই ইসলাম গ্রহণ করার ইচ্ছা পোষন করে আসছি কিন্তু কোথায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করব তা স্থির করতে পারিনি, তখন আমরা একদিন এক অদৃশ্য আহবানকারীর আহবান শুনতে পেলাম, কাউকে দেখলাম না। তিনি আমাদেরকে বললেন হে সফলকাম দল! তোমরা বাগদাদে যাও এবং শায়খ গাউসুল আজমের হাতে ইসলাম গ্রহণ কর, কেননা তাঁর বরকতে তোমাদের অন্তরে ঈমানের দৌলত দান করা হবে। এ নিয়ামত পৃথিবীর কোন স্থানে পাওয়া যাবেনা। (বাহজাতুল আসরার)
ওয়াজ অবস্থায় বৃষ্টি বন্ধ হয়ে হয়ে গেল:
হযরত শায়খ হাম্মাদ (র.) বলেন, একদিন হযরত মুহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (র.) খোলা আকাশের নীচে ময়দানে ওয়াজ করছিলেন, তাঁর ওয়াজকালে বৃষ্টি আসল, তখন তিনি তাঁর মস্তক মোবারক উত্তোলন করে বললেন, আমি হেদায়তের উদ্দেশে লোকদের সমবেত করেছি, আর আপনি তাদেরকে বিক্ষিপ্ত করছেন, হযরত শায়খ হাম্মাদ বলেন, তখন আল্লাহ তা’আলার হুকুমে মজলিসের উপর থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে গেল। (বাহজাতুল আসরার)
এশার ওযু দিয়ে ফজর নামায আদায়:
হযরত শায়খ আবদুল কাদির জিলানি শরীয়তের পূর্ণ পাবন্দ ছিলেন। হযরত আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আবুল ফাতাহ হারাভী বলেন, আমি চল্লিশ বছর যাবৎ গাউসে পাকের খিদমত করেছি, এ সুদীর্ঘ সময়ে আমি দেখেছি, তিনি এশার নামাযের ওযু দিয়ে ফজরের নামায আদায় করতেন। যখনই বেঅযু হতেন সাথে সাথে অযু করে নিতেন এবং দু রাকাত নফল নামায আদায় করতেন। (বাহজাতুল আসরার)
এক ব্যক্তি স্ত্রীকে তিন তালাক প্রদানের শপথ ও গউসে পাকের ফায়সালা:
গাউসে পাক (র.)’র পুত্র হযরত আবদুর রাযযাক বলেন, ইরাকের বাইরে থেকে ফতওয়া তলব করে বাগদাদে এক লোককে পাঠানো হলো, বাগদাদের শীর্ষ আলেমদের কাছে ফতোয়ার সমাধান চাওয়া হলো, কেউ সঠিক উত্তর দানে সক্ষম হলো না, প্রশ্ন হলো এক লোক স্ত্রীকে তিনি তালাক দেয়ার শপথ করেছে যদি না সে এমন ইবাদত করতে পারে যে ইবাদত করার সময় পৃথিবীর অন্য কোন মানুষ একই ইবাদতে লিপ্ত থাকতে পারবেনা। শেষ পর্যন্ত আলিমগণ সবাই আমার আব্বার কাছে সমাধান চাইলেন, তিনি তাৎক্ষনিক লিখিত জবাব দিলেন, ঐ লোকের জন্য মাতাফ বা ক্বাবা চত্বরকে উন্মূক্ত করে দেয়া হবে সেখানে সে একাকী সাতটি চক্কর দিয়ে তাওয়াফ পূর্ণ করবে তাহলে তার শাপথ পূর্ণ হয়ে যাবে। ফতোয়াপ্রার্থী জটিল বিষয়ের সমাধান পেয়ে সন্তুষ্টচিত্তে চলে গেল। (গিবতাতুন নাযির, ‘ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (রহ.)
ইন্তিকাল: হযরত শায়খ আবদুল কাদির জিলানি (রহ.) ৯১ বছর বয়সে ৫৬১ হিজরিতে ইন্তিকাল করেন। ইন্তিকালের পূর্বে ছেলে আবদুল ওয়াহহাবকে গুরুত্বপূর্ণ অসিয়ত করেন, সর্বদা আল্লাহকে ভয় করবে। আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে, তোমার সব প্রয়োজন আল্লাহর উপর ন্যস্ত করবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে হযরত বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)’র জীবনাদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।