সত্যব্রত বড়ুয়া পাঠক ও সুধী সমাজের কাছে সমধিক পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন একজন ‘রম্যসাহিত্যিক’ বা রম্য লেখক হিসেবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো রম্য লেখক হিসেবে উনি পাঠক প্রিয় হলেও মূলত কবিতাই ছিল তাঁর লেখালেখির প্রকৃত ও প্রাথমিক বিচরণ ক্ষেত্র। এক সময় একটানা তিনি বহু কবিতা লিখেছিলেন। নিজ হাতে লেখা তাঁর একটি কবিতা সংকলনও ছিল। স্বাধীনতা–পূর্ব বাংলাদেশে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাপ্তাহিক সাময়িকী পাতায় ‘আমায় ক্ষমা কর’ শিরোনামের একটি কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর লেখক হিসেবে সর্ব প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক জনকণ্ঠ ইত্যাদি জাতীয় পত্রিকা ও বিভিন্ন সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত চাকরি জীবনে বিভিন্ন জায়গায় বদলি হওয়ার কারণে সেই হাতে লেখা সংকলনটি হারিয়ে যায়। বিশেষ করে কিশোর–তরুণ বয়স তথা, স্কুল –কলেজ জীবনে তিনি অধিকাংশ কবিতা লেখেন। চাকুরী জীবনে এসেও এর ধারাবাহিকতা অনেকদিন অব্যাহত ছিল। প্রকৃতপক্ষে কৈশোর বয়স থেকেই কবিতা লেখায় তাঁর হাতেখড়ি। তিনি ‘সুরের পিয়াসী’ নামে একটি নাটকও লেখেন। যা মঞ্চস্থও হয়েছিল। অবসরোত্তর জীবনে বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ পত্রিকায় ‘বাঁকাচোখে’ নামে কলাম লেখায় প্রবেশের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে একটা পর্যায়ে সত্যদা পাঠক নন্দিত কলামিস্ট ও রম্যসাহিত্যিক হিসেবে পাঠক প্রিয় হয়ে ওঠেন। এরপর দৈনিক আজাদী পত্রিকায় রম্য বিষয়ে নিয়মিত লিখতে থাকেন। যা ধারাবাহিকভাবে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত ছিল (এমনকি মৃত্যুর পরও একটি রম্য লেখা প্রকাশিত হয়)। মূলত তাঁর প্রথম রম্যগ্রন্থ ‘বাঁকা চোখে’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন এবং ক্রমশ রম্যসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর পরিচিতির বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। পত্র–পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর রম্যকথনের পাশাপাশি পরপর কয়েকটি রম্য গ্রন্থ প্রকাশনার ফলে রম্যসাহিত্যিক হিসেবে ধীরে ধীরে তাঁর দৃঢ় ভিত গড়ে উঠতে থাকে। কেবল লেখার কারণেই নয়, বিভিন্ন মঞ্চ, সভা, বৈঠক,আলোচনায় তাঁর রম্য–রসাল গল্প ও কথপোকথন এবং আড্ডা ইত্যাদি কারণেও তিনি একজন রম্য–রসিক ব্যক্তি হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত হয়ে ওঠেন। নিয়মিত কলাম লিখতেন বলে তিনি রম্য লেখকের পাশাপাশি কলামিস্ট পরিচিতিও লাভ করেছিলেন। তিনি কারো সাথে কথা বলা শুরু করলে একটানা বলে যেতে পারতেন এবং এতই মজার মজার রসালো কথা বলতেন তাতে শ্রোতা এমনভাবে সম্মোহিত হয়ে পড়তেন যে সময় জ্ঞান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলতেন। মেজদার কথার জালে পাছে আটকে যান সে ভয়ে অনেক সময় কেউ কেউ তাঁকে এড়িয়েও যেতে চাইতেন বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনি একজন ভীষণ চলচ্চিত্রপ্রেমী ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা–পূর্ব তৎকালীন পাকিস্তান শাসনামলে যখন ভারতীয় সিনেমা অবাধে প্রদর্শিত হতো তখন দেখতাম সত্যদা একটার পর একটা ছবি দেখে চলেছেন। আবার বিশেষ করে তা যদি হয় উত্তম –সুচিত্রা জুটির সিনেমা। সুচিত্রা সেনের বড় ভক্ত ছিলেন। তিনি গায়ক না হলেও গানের প্রতি তাঁর দারুণ ঝোঁক ছিল। তিনি একজন রম্যসাহিত্যিক হলেও তাঁর মাঝে ছিল অগাধ জ্ঞান গাম্ভীর্য ও গভীর সাহিত্যবোধ এবং পাণ্ডিত্য। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। একসময় তিনি চট্টগ্রামের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তিকে নিয়ে তাঁর নিজ গৃহে চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে বৈঠকী আড্ডায় বসতেন। যা খুব বেশী দিন আর এগোয় নি। তিনি বিশেষত চট্টগ্রামের শারস্বত সমাজে নিজের একটা বিশেষ স্থান করে নিতে পেরেছিলেন এবং চট্টগ্রামের অনেক নবীন প্রবীণ বিশিষ্ট জ্ঞানী –গুণী–লেখক–শিল্পী–সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সাথে তাঁর নিবিড় সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
তিনি লিখেছিলেন শিশুদের উপযোগী বিভিন্ন রচনাও। স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন তাঁর কাছে লেখা চেয়ে প্রায়ই অনুরোধ করতো। প্রকৃতপক্ষে সত্যব্রত বড়ুয়া ছিলেন বইয়ের জগতের এক নিবিড় বাসিন্দা। কিংবা বই প্রেমিক বা বইয়ের পোকা যা–ই বলি না কেন। নিজের গড়ে তোলা ঘরোয়া লইব্রেরীর পাশাপাশি নিজ কর্মস্থলের বিভিন্ন পাঠাগারে সবসময় পাঠে নিবিষ্ট থাকতেন। বই –এর প্রতি তাঁর ভালোবাসা এতখানি গভীর ছিল বলে হয়তো তিনি তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বাঁকা চোখে’র প্রকাশনা উৎসবে বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর আমার শব দেহের চারপাশে ফুল নয়, বই দিয়ে যেন সাজিয়ে রাখা হয়।’ তাই সত্যদা ‘র অন্ত্যষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে পরিবারের সদস্যরা তাঁর শবদেহের চারপাশে বই সাজিয়ে রেখেছিল। বইয়ের প্রতি ভালোবাসার বোধ থেকে এবং বৌদ্ধ ধর্ম জ্ঞানের ধর্ম বলে তিনি বৌদ্ধ বিহারগুলোতে পাঠাগার স্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রকৃত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়ার জন্য বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ সংগঠনগুলোকে আবেদন জানাতেন। তিনি বিজ্ঞান চিন্তা, বিজ্ঞান বিচিত্রা ইত্যাদি বিজ্ঞান সাময়িকীর নিয়মিত গ্রাহকও ছিলেন। প্রসঙ্গত তিনি উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। বাবার ইচ্ছে ছিল তাঁকে চিকিৎসা বিষয়ে লেখাপড়া করাবেন। শেষ পর্যন্ত হলেন কৃষিবিদ। পথে পথে ঘুরে রাস্তার ফুটপাতের পুরোনো বই বিক্রেতাদের স্তুপ থেকে ভালো ভালো বই খুঁজে বের করাও তাঁর বড় নেশা ছিল। বই কেনার ব্যাপারে আর্থিক সীমাবদ্ধতাকে তিনি কখনো ধর্তব্যের মধ্যে নিতেন না। কেবল বই কেনার ব্যাপারেই নয় যে–কোনো জনহিতৈষী কাজে তিনি সাধ্যমত তাঁর উদার হস্ত বাড়িয়ে দিতেন। রম্য সাহিত্যিক পরিচিতির মাঝে কেবল তাঁর কবি পরিচিতিই আড়াল হয়ে যায় নি তাঁর আরো অনন্য গুণাবলীও যেন কিছুটা আড়াল হয়ে গেছে। আমরা ছেলেবেলায় দেখেছি তিনি মজার মজার যাদু দেখাতেন। সাড়ে তিন হাত লম্বা মানুষকে কিভাবে সাড়ে তিন ফুট মানুষে পরিণত করেছিলেন ছোট বেলায় মেজদার দেখানো রহস্যময় যাদু আজো স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করে ভাসে। আস্ত পুরো একটা খবরের কাগজ টুকরো টুকরো করে মুখে খেয়ে আবার কাগজগুলো মুখ দিয়ে পাইপ আকারে বের করতেন যাদুকর সত্যদা। অবাক হয়ে আমরা শৈশব–কৈশোরে সে যাদুও দেখেছি। দুটো বাঁশের ওপর ভর করে তিনি মাঠ কিংবা উঠোনে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সে শারীরিক কসরতও দেখেছি। এরকম নানা এ্যাক্রোবেটিসও তাঁকে দেখাতে দেখেছি। একজন দক্ষ সাইক্লিস্ট ছিলেন। দিব্যি দু’হাত ছেড়ে অনেক দূর সাইকেল চালিয়ে যেতে পারতেন। আবার কখনো খুব ধীর গতিতে চালাতেন, কখনো –বা একেবারে থেমে থেকে সাইকেলে বসে থাকতেন। নিজেকে নিয়ে নানান পরীক্ষা –নিরীক্ষা করাও তাঁর এক ধরনের শখ ছিল। কলকাতার দ্বি–চাকার রিকশাওয়ালাদের অনুকরণে একবার তিনি ছোলার ছাতু খেয়ে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করতে গিয়ে অস্বাভাবিক পেটের রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হঠাৎ কাউকে ভয় দেখানো, জোকার সাজা কিশোর বয়সে তাঁর এক ধরনের শখ ছিল। শিল্প ও চিত্রের প্রতিও তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। যেকোন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিংবা ব্যতিক্রম ছবি তাঁর সংগ্রহে রাখতেন।তিনি কেবল যে পরিবারের এক মস্ত বড় ছাতা বা আশ্রয় ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন মানবিক বোধসম্পন্ন সংস্কারমুক্ত প্রবল আত্মবিশ্বাসী মানুষ। দুঃসময়ে শিল্পী–সাহিত্যিক–অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সব সময়, সহজ–সরল জীবন যাপন করলেও ছিল তাঁর কঠিন মনোবল, ছিলেন দৃঢ় চিত্তের অধিকারী। এবং সৎসাহসের অধিকারী। এই ছিপছিপে মানুষটি এক সময় ফুটবলার ছিল, তরুণ বয়সে পাঠ্যাবস্থায় ছিলেন গোল কিপার, স্কাউট ট্রুপ লীডার ছিলেন, কলেজিয়েট স্কুলে ছাত্রাবস্থায় ছিলেন অন্যতম বক্সার। ভালো তবলা বাজাতে জানতেন। বিভিন্ন সামাজিক –সাংস্কৃতিক –সাহিত্য সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি কেবল নিজে পাঠক ছিলেন তা নয়, নবীন লেখকদের সব সময় উৎসাহ দিতেন। পরিবারের ছোট–বড় সবাইকে সব সময় বলতেন, নিজেদের স্বপ্ন নিয়ে, জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে চাইলেই কিছু লেখা যায়। তাঁর একান্ত ইচ্ছে হতো সবাই লেখক হয়ে উঠুক।
সব কিছু ছাপিয়ে সত্যব্রত বড়ুয়া হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় মানুষ। অনেকে প্রিয় লেখক হন, কিন্তু সবাই প্রিয় মানুষ হয়ে ওঠেন না। সত্যবাবু প্রিয় লেখক এবং প্রিয় মানুষ দুই ছিলেন। এখানেই লেখক সত্যব্রতের সার্থকতা। সত্যবাবু লেখায় যেমন তিনি মানবিক ছিলেন, মানুষের পাশে বাস্তবে দাঁড়িয়ে থেকেও তিনি মানবিক ছিলেন। একজন লেখক মানবিক হলে তিনিই বোধ করি একজন প্রকৃত লেখক হয়ে ওঠেন। যা অনেক লেখকের মাঝে তা লক্ষ করা যায় না। সেই লেখক ছিলেন সত্যবাবু যিনি লেখায় এবং জীবন চর্চায় ছিলেন মানবিক।
আমার রচিত কবিতা, গল্প, নাটক ও প্রবন্ধের ৪টি বই চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশন ও আগডুম বাগডুম প্রকাশনা সংস্থা থেকে সমপ্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এ ৪টি বই প্রকাশের পেছনে মেজদা মানে সত্যব্রতদা ‘র প্রেরণা আমাকে সাহস ও উৎসাহ দু–ই যুগিয়েছে। যিনি প্রায় প্রতিটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন। ভাই একজন পরম বন্ধু হয়ে ওঠা জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। মেজদা আমার জীবনে প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠছিলেন। অগ্রজ বন্ধু হয়ে ওঠায় একজন লেখকের খাতায় আমার ঠাঁই হয়েছে। সেই প্রাপ্তি ভাগ্যে জুটেছিল এ মহৎপ্রাণ রম্যলেখকের হাত ধরে। মেজদা, তোমাকে জানাই অগণন সভক্তি প্রণতি।
লেখক : সত্যব্রত বড়ুয়া ছোটো ভাই; সাহিত্যিক।