চট্টগ্রাম জেলাজুড়ে ব্যাটারি রিকশা ও সিএনজি টেক্সি ছিনতাই চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ছিনতাইয়ের সময় বাড়াবাড়ি করলে মারধর, এমনকি খুনের শিকার পর্যন্ত হচ্ছেন চালকরা। গত ৩ সেপ্টেম্বর পটিয়া এবং গত ৩০ সেপ্টেম্বর সীতাকুণ্ডে সংঘটিত পৃথক দুটি ছিনতাই ঘটনায় খুন হয়েছেন দুজন ব্যাটারি রিকশা চালক। প্রায় ১ মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামে জিহাদ ও শহীদ নামের উক্ত দুজন রিকশা চালক খুন হলেন।
পুলিশ বলছে, রিকশা ও টেক্সি ছিনতাই, এর চালকদের মারধর, এমনকি চালক খুন হওয়ার বিষয়টি নজরে রয়েছে। সেই অনুযায়ী অপরাধীদের ধরাও হচ্ছে। কিন্তু জামিনে বের হয়ে ফের তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। বেশি সময় ধরে যদি তাদের হাজতে রাখা যেত তাহলে হয়তো তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমে আসতো।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সীতাকুণ্ডে এক কিশোরকে গলা কেটে খুন করে ছিনতাই করা হয়েছে তার ব্যাটারি রিকশা। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুই ছিনতাইকারীকে। খুনের শিকার কিশোর ব্যাটারি রিকশা চালক জিহাদ মূলত একজন শিক্ষার্থী। তিনি স্থানীয় একটি স্কুলের ৭ম শ্রেণীতে পড়ছিলেন। পরিবারে আর্থিক সহায়তা দিতেই তিনি রাতের বেলা রিকশা চালাতেন। পুলিশ জানায়, ঘটনার পরদিন গত বুধবার সীতাকুণ্ডের শেখপাড়া এলাকায় ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ থেকে জিহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। আগেরদিন মঙ্গলবার দুই ছিনতাইকারী যাত্রীবেসে জিহাদের রিকশায় উঠেন। কিছুদূর যাওয়ার পর রিকশাটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হলে বাধা দেওয়া হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলাসহ জিহাদের শরীরের নানা জায়গায় আঘাত করে দুই ছিনতাইকারী। এতে জিহাদের মৃত্যু হয়। পরে জিহাদের রিকশাটি একটি গ্যারেজে বিক্রি করতে নিয়ে গেলে দুই ছিনতাইকারী গ্যারেজ মালিক ও স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়ে। পরে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। গ্রেপ্তার দুই ছিনতাইকারী হলেন বাপ্পী ও রাজীব।
গ্যারেজ মালিক জানান, মাত্র ১০ হাজার টাকায় ব্যাটারি রিকশা বিক্রি করতে চেয়েছিল দুই ছিনতাইকারী। সন্দেহ হলে রিকশার পেছনে থাকা ফোন নম্বরে কল করলে রিকশা মালিক চালকের খোঁজ করেন। সেই অনুযায়ী দুই ছিনতাইকারীকে চালকের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা অস্বাভাবিক আচরণ করেন এবং ধরা পড়ে যান। এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর পটিয়ার দক্ষিণ ভূর্ষি এলাকায় ৩০ বছর বয়সী ব্যাটারি রিকশা চালক মো. শহীদকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। শহীদের ব্যাটারি রিকশাটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হয়েছিল। এতে তিনি বাধা দিলে ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে বসেন।
পুলিশ জানায়, সম্প্রতি চট্টগ্রামে বেশ কিছু রিকশা, সিএনজি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে খুনের ঘটনার পাশাপাশি চালককে মারধরের ঘটনাও রয়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর জেলার চন্দনাইশের দোহাজারী বাজার থেকে যাত্রীবেসে একটি সিএনজি ভাড়া নেন কয়েকজনের একটি চক্র। ঘুরার কথা বলে তারা সিএনজিটিতে উঠে চন্দনাইশ থানাধীন গহীন পাহাড়ে চলে যান। একপর্যায়ে সেখানে মারধর এবং হাত–পা ও মুখ বেধে চালককে রাস্তায় বসিয়ে রেখে চক্রটি তার সিএনজি অটোরিকশাটি ছিনতাই করে নিযে যান। এ ঘটনায় চালক মামলা দায়ের করলে পুলিশ হাটহাজারীর আমানবাজার এলাকা থেকে চক্রের প্রধান সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, তিনি ও তার সহযোগীরা দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি তারা একাধিক সিএনজি টেক্সি ছিনতাই করেছে বলেও পুলিশকে জানিয়েছেন। এর আগে গত ২৮ জুলাই রাতের বেলা সিএনজি নিয়ে গ্যারেজে যাচ্ছিলেন সিএনজি চালক মো. ফাহিম। পথে অর্থাৎ নগরীর আগ্রাবাদ ব্র্যাক ব্যাংকের সামনে সিএনজিতে সমস্যা দেখা দিলে তিনি গাড়ি থামিয়ে কী হয়েছে তা দেখছিলেন। এ সময় চার ছিনতাইকারী ছোরা ধরে ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং তাকে ধাক্কা দিয়ে গাড়িটি নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এ বিষয়ে সিএনজি চালক একটি মামলা রুজু করলে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ছিনতাইকৃত সিএনজি টেক্সিটি ও ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত ছোরাসহ সংঘবদ্ধ ছিনতাই চক্রের চারজনকে নোয়াখালী থেকে গ্রেপ্তার করে।
এ বিষয়ে ডবলমুরিং থানার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেছিলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা নগরীর ছিনতাই চক্রের সক্রিয় সদস্য। তারা দীর্ঘদিন ধরে সিএনজি ছিনতাইকরাসহ পথচারীদের মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনতাই করে আসছিল।
জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, গত এপ্রিলে নগরীর কর্ণফুলী থানাধীন মইজ্জারটেক এলাকা থেকে যাত্রীবেসে একটি সিএনজি টেক্সিতে উঠেছিলেন কয়েকজন ছিনতাইকারী। একপর্যায়ে তারা চালককে ছুরি ধরে হত্যার হুমকি দিয়ে মারধর করে গাড়ি থেকে ফেলে দেন এবং গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে যান। এ ঘটনার পর গত ১০ এপ্রিল চট্টগ্রাম–কাপ্তাই সড়কের দাগোয়ান এলাকা থেকে ছিনতাই হওয়া সিএনজি টেক্সিটিসহ দুইজন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে রাউজান থানা পুলিশ। তারা হলেন খোকন ও আওলাদ। এ দুজনসহ তাদের সহযোগীরা নগরীর বাকলিয়া ও রাহাত্তারপুল এলাকায় বসবাস করতেন।
সামগ্রিক বিষয়ে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মো. রাসেল দৈনিক আজাদীকে বলেন, রিকশা, সিএনজি ছিনতাইয়ে যারা জড়িত তারা সবাই অভ্যাসগত ছিনতাইকারী। প্রায় সব ঘটনায় আসামি গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু জামিনে দ্রুত বের হয়ে পড়েন এসব ছিনতাইকারী। যার কারণে ঘটতেই থাকে ঘটনা। বেশি সময় ধরে যদি তাদের হাজতে রাখা যায়, সেক্ষেত্রে হয়তো ছিনতাইকারীদের মধ্যে ছিনতাই প্রবণতা কমে আসতো। যদিও জামিন পাওয়া প্রত্যেকের অধিকার বলেও জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, পটিয়ার ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য মামলা। প্রায় সবগুলোই ছিনতাই সংক্রান্ত। এসব অপরাধীদের ধরতে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের টিম সর্বদা কাজ করছেন।