স্তন ক্যান্সার একটি আতঙ্কের নাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী নারীরা যেসব ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তার মধ্যে স্তন ক্যান্সারের স্থান শীর্ষে। আমেরিকায় প্রতি ৮ জন মহিলার ১ জনের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি আছে। বাংলাদেশেও এই ক্যান্সারের প্রকোপ ও ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। দেশে প্রতিবছর ১৩ হাজার নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং এবং সার্ভিল্যান্সের অভাবে বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সারে মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
যদিও বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে কিন্তু যে কোনো বয়সের মহিলাই এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। যে সমস্ত মহিলার মা, বোন, খালা অথবা নানীর এই ক্যান্সারের ইতিহাস আছে তাদের এই ক্যান্সারের ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে বেশি থাকে। কাজেই এদের ক্ষেত্রে নিয়মিত স্তন পরীক্ষা করা প্রয়োজন অর্থ্যাৎ Screening করা অধিক প্রয়োজন। এছাড়া ওজনাধিক্যতা/স্থুলতা, ধূমপান, মদ্যপান, দুশ্চিন্তা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন (দীর্ঘমেয়াদী), হরমোনের ঔষধ সেবন ইত্যাদি স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যদিকে গর্ভবতী হওয়া এবং বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় বলে ধারণা করা হয়।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ কী? এক কথায় বলতে গেলে স্তনে কোন গোটা বা চাকা আছে কিনা সেটাই বলতে হবে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগী এই লক্ষণ নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। মনে রাখতে হবে এই গোটা বা চাকা হয় ব্যথাহীন। ব্যথা থাকে না বলেই রোগীরা অনেক দেরীতে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। তাই ব্যথাহীন কোনো চাকা বা গোটা অনুভব হলে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। কেউ কেউ আবার স্তনের বোটা থেকে রসনিঃসরণ কিংবা বোটা ভিতরের দিকে ঢুকে যাওয়া অথবা চামড়া কুঁচকে যাওয়া এমনকি বগলে গোটা নিয়েও ডাক্তারের শরণাপন্ন্ন হতে পারে। খুব বেশি দেরি করলে ব্রেস্টে ঘা নিয়ে আসতে পারে অথবা শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে গিয়ে সে অনুযায়ী বিভিন্ন লক্ষণ নিয়ে আসতে পারে। যেমন লিভারে ছড়ালে জন্ডিস, হাড়ে ছড়ালে তীব্র কোমড় ব্যথা, ফুসফুসে ছড়ালে শ্বাসকষ্ট, ব্রেইনে ছড়ালে তীব্র মাথাব্যথা, চোখের সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আসতে পারে। কাজেই চল্লিশোর্ধ মহিলাদের অথবা যারা হাই রিস্ক অর্থাৎ যাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাদের Screening করা প্রয়োজন।
স্তন ক্যান্সার Screening এর তিনটি অংশ আছে। প্রথমটি হলো (BSE/Breast Self Exam) প্রতিমাসে একবার করে (মাসিকের ৭ম দিনে হলে ভালো) নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা করা এবং কোনো গোটা বা চাকা হাতে লাগলে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের কাছে যাওয়া। দ্বিতীয়টি হলো (CBE/ Clinical Breast Exam) যেখানে ডাক্তার স্তন পরীক্ষা করে দেখবেন এবং তৃতীয়টি হলে ম্যামোগ্রাম যা স্তনের একটি স্পেশাল এক্সরে। এই Screening এর উদ্দেশ্য হলো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তকরণ যাতে রোগের চিকিৎসা সহজ হয় এবং রোগীর Progonosis/ ফলাফল ভালো হয় অর্থাৎ রোগ সংশ্লিষ্ট জটিলতা কমে এবং রোগীর কষ্ট লাঘব হয়, পরিণতিতে রোগী দীর্ঘায়ু হয়। অতএব আসুন আমরা সবাই সচেতন হই, প্রতিমাসে নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করি। কোনো লক্ষণ দেখলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। High Risk রোগীদের ক্ষেত্রে Screenin করাই। স্তন ক্যান্সারের ভয়াবহতা থেকে নিজে বাঁচি এবং অন্যকে বাঁচাই।
স্তন ক্যান্সারের বিভিন্ন রকম চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। যেমন সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোন থেরাপি, ইমিউনো থেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি এবং অন্যান্য। সার্জারি আবার বিভিন্ন রকম হতে পারে, পুরো ব্রেস্ট কেটে যেমন অপারেশন করা যায় তেমনি পুরো ব্রেস্ট না কেটে শুধুমাত্র গোটা বা চাকা কেটেও অপারেশন করা যায় এবং এই পদ্ধতিই এখন বেশি প্রচলিত। কেননা তাতে রোগীর শারীরিক ও মানসিক দুদিক থেকেই উপকার হয়। যদিও মনে হতে পারে পুরো ব্রেস্ট কেটে না ফেলাতে ক্যান্সার আবারও হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে, কিন্তুু গবেষণামতে দুই পদ্ধতিতেই পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনায় উল্লেখ্যযোগ্য কোনো পার্থক্য হয় না। তবে ব্রেস্ট রেখে অপারেশন করলে রেডিও থেরাপি অবশ্যই দিতে হয়। অপারেশন পরবর্তী ব্রেস্টের সৌন্দর্য্য রক্ষার্থে প্লাস্টিক সার্জারিও করা যায় (Oncoplastic breast Surgery)। তবে এরকম চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ সনাক্তকরণ।
অতএব আসুন আমরা সবাই সচেতন হই, প্রতিমাসে নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করি। কোনো লক্ষণ দেখলে ডাক্তারের বিশেষ করে সার্জারি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হই। High risk রোগীদের ক্ষেত্রে Screening করাই। স্তন ক্যান্সারের ভয়াবহতা থেকে নিজে বাঁচি এবং অন্যকে বাঁচাই।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (সার্জারি), চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।