দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১ অক্টোবর, ২০২৫ at ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মেলবোর্ন শহর থেকে আমরা যখন গাড়িতে চড়লাম তখন জানতামই না যে, সন্ধ্যাটা কী মোহনীয় হয়েই না আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে! কখনো আট লেন, কখনো ছয় লেন, কখনোবা চার লেনের ছবির মতো সুন্দর রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছিলাম আমরা। আমাদের গন্তব্য প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার দূরের ফিলিপ আইল্যান্ড। যেতে নাকি দুই ঘন্টার মতো সময় লাগবে। ফিলিপ আইল্যান্ড ভারত মহাসাগরের বুকের ছোট্ট একটি দ্বীপ। স্থলভাগের সাথে ব্রিজের মাধ্যমে দ্বীপটির সংযোগ ঘটানো হয়েছে।

শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে ছুটে চলছি আমরা। শহর ছাড়ার পর মনে হচ্ছিলো গ্রামবাংলার শস্যশ্যামলা প্রান্তর পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। সবুজে সবুজে একাকার চারদিক। তবে গ্রামবাংলার সাথে পার্থক্যটা খুবই দৃশ্যমান। রাস্তাগুলো অন্যরকম, ঘরবাড়িগুলো নজরকাড়া, গাছে গাছে অচিন পাখীর কলকাকলী। ছবির মতো সুন্দর চারপাশ, সাজানো গুছানো সবকিছু। প্রায় দেড়শ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম ফিলিপ দ্বীপের কাছে, ব্রিজ পার হলেই দ্বীপ। সেখানে পৌঁছে পেয়ে গেলাম যেনো অন্যজগত। একদিকে মহাসাগরের ঢেউ, অন্যদিকে সবুজ চারণভূমি ও বনবনানী প্রকৃতিতে যেনো ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে।

দ্বীপজুড়ে গড়ে তোলা রাস্তাগুলো চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। দুইপাশে বুনো সব গাছগাছালীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চমৎকার পিচঢালা রাস্তা। ঘন জঙ্গলও দেখা গেলো, কিন্তু কোথাও যেনো কোন জঞ্জাল নেই, ঝঞ্জাট নেই। দ্বীপজুড়ে রয়েছে চকলেট ফ্যাক্টরি, গরু এবং দুধের খামার, আছে ঘোড়ার খামারও। গরুর খামারে অস্ট্রেলিয়ান গরু ঘাষ খাচ্ছিলো, ঘোড়ার খামারেও ছোটাছুটি করছিলো তাগড়া তাগড়া অস্ট্রেলিয়ান হর্স। সবজির ক্ষেত কিংবা পশুর চারণভূমিসহ সবকিছু ছবির মতো সুন্দর, সাজানো। নানা প্রজাতির লাখো কোটি গাছগাছালী দ্বীপজুড়ে। ছোট্ট একটি দ্বীপকে কিভাবে যে এতো সুন্দর করে সাজিয়ে এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মুলধারায় যুক্ত রাখা যায় কে জানে!

আমাদেরকে একটি চকলেট ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়া হলো। চকলেটের গন্ধে মৌ মৌ করছিল চারদিক। আমি আরো বহু চকলেট ফ্যাক্টরিতে গিয়েছি, দেখার সুযোগও হয়েছে। কিন্তু এই ফ্যাক্টরি যেনো কিছুটা অন্যরকম। প্রতিটি ফ্যাক্টরিতেই পর্যটকদের দুধ থেকে চকলেট বানানোর দীর্ঘ প্রক্রিয়া দেখানো হয়।কিছু কিছু চকলেট পর্যটকদের খেয়ে টেস্ট করতেও দেয়া হয়। পরে বিক্রি করার চেষ্টা করা হয় চকলেট। আমি জানি যে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হবে না। এগুলো গাইডদের কারসাজি। তারা এসব ফ্যাক্টরির সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকে। ঠিকঠাকভাবে কাস্টমার নিয়ে আসলে তার কমিশন ঘরে পৌঁছে যায়। আমাদের গাইড সাহেবের চেহারাও বেশ উজ্জ্বল দেখা যাচ্ছিলো। আমার ভালো লাগলো যে, আমাদের দিয়ে যদি কেউ দু’চার টাকা আয় করে মন্দ কি? এই টাকা দিয়েই হয়তো আজ রাতে তার পরিবারে আনন্দের বান ডাকবে। টুকটাক চকলেট তো আমরা সবাই কমবেশি কিনবো, হোক সেটা ফ্যাক্টরি থেকে কিংবা বিমানবন্দরের ডিউটি ফ্রি শপে। এখান থেকে কিনলে যদি গাইড সাহেব লাভবান হোন তো আমাদের ক্ষতি কী!

দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ পেঙ্গুইন প্যারেড। সাগরের পেঙ্গুইন যে আবার কী করে প্যারেড করে কে জানে! বিষয়টি বুঝতে না পারলেও সবার কাছ থেকে শুনে বেশ রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। পেঙ্গুইন বেশ সুন্দর একটি প্রাণী। এটির প্যারেড দেখতে নিশ্চয় খারাপ লাগবে না। আমি পেঙ্গুইন প্যারেড দেখার জন্য ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠলাম। কিন্তু সময় না হলে তো আর পেঙ্গুইন দেখা দেবে না।

সাগর পাড়ের কয়েকশ’ একর জায়গাজুড়ে বুনো একটি আবহ ধরে রাখা হয়েছে। ছবির মতো সুন্দর এই আবহের বর্ণনা দেয়া অসম্ভব। অনন্য সুন্দর বললেও কম বলা হবে। বন আর গাছগাছালীতে হাজার হাজার গাংচিলসহ নানা প্রাণীর বসতি। বাঘ ভাল্লুক যে নেই তা নিশ্চিত, তবে দ্বীপের গাছগাছালীর অনেকগুলোই আমাদের সুন্দরবনের মতো। সূর্যাস্তের পর দ্বীপের এই বনে ছবি তোলা, ভিডিও করা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ। কোন ধরনের গানবাজনা বা শোরচিৎকারের সুযোগ নেই। পেঙ্গুইনসহ বনের প্রাণীদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেজন্য এই বিশেষ কড়াকড়ি। ক্যামেরার ফ্লাশলাইট জ্বললে ক্যামেরা কেড়ে নেবে বলেও গাইড সতর্ক করে দিল। অথচ আমাদের সুন্দরবনে গভীর রাতে জাহাজে জাহাজে ডিজে পার্টি চলে। নৌযানের হেডলাইটে বন আলোকিত হয়ে উঠে। তাতে বন্যপ্রাণীর কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে কারো তেমন কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয়নি।

দ্বীপে বনাঞ্চল একপাশে রেখে সাগরের একেবারে কোল ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে স্টেডিয়ামের মতো গ্যালরি। কী অনন্য নির্মাণ, গ্যালরির কাছ থেকে বিস্তৃত বিচ, ভারত মহাসাগরের বিচ। বিচে আছড়ে আছড়ে পড়ছে মহাসাগরের ঢেউ, যেনো এক একটি মুক্তোর মালা। বিচে আছড়ে পড়া এক একটি ঢেউ কী যে রোমাঞ্চ ছড়াচ্ছিল!

গ্যালারিতে কয়েক হাজার মানুষের একসাথে বসার ব্যবস্থা। পেঙ্গুইন প্যারেড দেখতে আসা নারী পুরুষ ও শিশু কিশোরে গ্যালরিগুলো কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল সূর্যাস্তের আগেই। এসব মানুষকে বিশাল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে চড়া দামের টিকেট করতে হয়েছে। পেঙ্গুইন দেখার জন্য প্রতিজনের জন্য ৩২ ডলারে (শিশুদের ১৬ ডলার) এবং ফ্যামিলি টিকেট ৮০ ডলারে কিনেই কেবল আধা কিলোমিটারের বেশি লম্বা চমৎকার একটি পথ মাড়িয়ে গ্যালারিতে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। পুরো পথটি পিচঢালা, কিছুটা অন্যরকমের পিচ। কোথাও কাঠের ব্রিজ, দুপাশে রেলিং দেয়া এই পথের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। পথের পাশেই ঘন ঘাস এবং নানা গাছগাছালীতে ঢেকে থাকা বনে হাঁস, গাংচিল এবং পেঙ্গুইনসহ নানা প্রাণীর অবাধ বসবাস, অভয়ারণ্য।

যাক, আমরা কয়েক হাজার মানুষ ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার তীব্র ঠান্ডার মধ্যে সাগরের ঢেউ দেখতে দেখতে পেঙ্গুইনের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। কবে আসবে কবি! কবে যে আসবে অনেকটা ভদ্রলোকের মতো ভীষন আদুরে পাখিটি! একজন নারী গাইড পেঙ্গুইন প্যারেড নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা বললেন। তিনি পেঙ্গুইন নিয়ে নানা তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করলেন। বহু কথা হলেও পেঙ্গুইনের দেখা মিলছিল না। আমি কিছুটা অস্থির হয়ে উঠছিলাম।

সন্ধ্যা নেমে গেছে। আকাশে ঝলমল করছে চাঁদ। মহাসাগরের পাড়ে বসে আছি আমরা। কী এক মোহনীয় আবহ চারদিকে। অচিন প্রকৃতি যেনো হাতছানী দিচ্ছে। ঢেউয়ের সাথে সাথে মহাসাগরে একটি ঝিলিকও যেনো চমকে চমকে দিচ্ছে। সাগরের শো শো শব্দ এবং ঢেউয়ের আছড়ে পড়া শব্দের মাঝে বসে আছি আমরা। গ্যালরিজুড়ে মানুষের অধীর আগ্রহ!

একেবারে হঠাৎই সাগরের ঢেউয়ের সাথে বিচে উঠে এলো একঝাঁক পেঙ্গুইন। যেনো ঢেউয়ের সাদা ফেনার ভিতর থেকে বের হয়ে এলো সাদাকালো পেঙ্গুইনগুলো। ১০/১২টি হবে। তারা হেলে দুলে বিচ পার হয়ে সামনের ঘন জঙ্গলে গা লুকালো। এরপর ক্রমান্বয়ে আরো অনেক ঝাঁক পেঙ্গুইন এসে একই কায়দায় বনে ঢুকলো। আসতে থাকলো, শত শত পেঙ্গুইন, এক ঝাঁকের রেশ মেলানোর আগে অপর ঝাঁক। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে কয়েকশ’ পেঙ্গুইন সাগর থেকে হেঁটে হেঁটে বনে ঢুকে পড়লো। আমাদেরকে কোন ছবি তুলতে দেয়া হলো না। যারাই মোবাইল বের করলো, তাদেরই ফোন নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে দিল। কর্মীরা হ্যান্ডমাইকে বারবার কোন আলো না ফেলার জন্য অনুরোধ করছিলেন। জ্যোৎস্নার আলোয় পেঙ্গুইনের পাল শুধু আমাদের চোখের সামনে দিয়েই নয়, মনে হলো মনের গভীরেও দাগ ফেলে ফেলে হেলে দুলে এগিয়ে যাচ্ছিলো। বনের নানা স্থানে পেঙ্গুইনের থাকার ঘর করে রাখা হয়েছে। টিকেট কাউন্টারের পাশে একটি বোর্ডে লিখে রাখা তথ্য থেকে জানতে পারলাম যে, আগের রাতে এই বনে ১২৪৪টি পেঙ্গুইন এসেছিল। আজও মনে হয় এর ধারে কাছের সংখ্যার পেঙ্গুইন প্যারেড দেখালো। পেঙ্গুইন প্যারেড শেষ হওয়ার পর কয়েক হাজার মানুষ ফিরতি পথ ধরলো। একই পথে ফিরে আসতে গিয়ে মানুষ যেনো চমকে চমকে থমকে থমকে যাচ্ছিলো। সাগর থেকে উঠে আসা পেঙ্গুইনগুলো জোড়া জোড়ায় পথের ধারে বসে আছে, নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছে। পথের পাশে মাটিতে জ্বালিয়ে রাখা স্পর্ট লাইটের আলোতে মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকা জলের পাখি পেঙ্গুইনগুলোকে কী যে আদর লাগছিল! ফিরছিলাম আমরা। পথের ধারে বসে থাকা পেঙ্গুইন দেখে দেখে পথ চলছিলাম। বেশ রাত নেমে গেছে। হঠাৎই খেয়াল হলো যে, দ্বীপের বনজুড়ে শুধু পেঙ্গুইনই নয়, জ্যোৎস্নারও বান ডেকেছে। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগুরুর মস্তক ভাঙছে শিষ্য
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবীণ জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশ