শিক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জনের বিষয় নয়, এটি একটি মানসিক, সামাজিক ও মানসিক বিকাশের প্রক্রিয়া। দুর্বল শিক্ষার্থীরা সাধারণত নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, ফলে তারা আরও পিছিয়ে পড়ে। সঠিক দিকনির্দেশনা, সহানুভূতি ও উৎসাহের মাধ্যমে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।
এক্ষেত্রে সর্ব প্রথম পরিবারকে সবচেয়ে আগে সচেতন হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে যে প্রতিটি শিশুর শেখার গতি, আগ্রহ ও ক্ষমতা ভিন্ন। দুর্বলতা মানেই অযোগ্যতা নয়। এমন শিক্ষার্থীদের প্রতি পরিবারকে সহানুভূতিশীল হতে হবে, তাদের ছোট ছোট সাফল্যকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং কখনোই অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানো, পড়াশোনায় সহায়তা করা, ভালোবাসা ও মানসিক সমর্থন দেওয়া–এসবই তাদের আত্মবিশ্বাস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এবারে আসি শিক্ষকদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিৎ?
শিক্ষকদের উচিৎ দুর্বল শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং তাদের শেখার ধরন বুঝে পাঠদানে পরিবর্তন আনা। ‘একই ছাঁচে ফেলা’ শিক্ষা পদ্ধতি দুর্বল শিক্ষার্থীদের আরও পিছিয়ে দেয়। তাদের প্রতি ধৈর্যশীল ও সহানুভূতিশীল আচরণ, শ্রেণিকক্ষে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি এবং অনুপ্রেরণা দেওয়ার মাধ্যমে তারা আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে পারে।
বিশ্বখ্যাত শিশু মনোবিজ্ঞানী Jean Piaget বলেন, Children learn best when they are actively involved in the process and when their individual differences are respected অর্থাৎ সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ব্যক্তিগত পার্থক্যকে সম্মান জানানো শিক্ষার মূল চাবিকাঠি।
Stanford University-এর গবেষক Carol Dweck তার Growth Mindest তত্ত্বে বলেন, যদি একজন শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে যে তার মেধা চর্চার মাধ্যমে উন্নত করা যায়, তবে সে আরও পরিশ্রমী ও স্থির মনোভাব নিয়ে কাজ করে। এই মানসিকতা দুর্বল শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে সহায়ক।
চলুন জেনে নিই এসব সংকট কাটানোর উপায় কী?
প্রথমত শিক্ষার্থীদের মাঝে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হবে। পরিবার ও শিক্ষকের উচিত দুর্বল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘আমি পারি’ মনোভাব তৈরি করা।
এরপর ব্যক্তিগত সহায়তা যেমন আলাদা করে সময় দেওয়া, পড়াশোনার কৌশল শেখানো ও মেন্টরিং অত্যন্ত কার্যকর। প্রশংসা ও পুরস্কার দেওয়াও আরেক ধরনের উৎসাহ প্রদান। ছোট ছোট উন্নতি বা সাফল্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে তারা উৎসাহিত হয়। সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষা যেমন ছবি, গল্প, নাটক বা গেমের মাধ্যমে শেখানোর পদ্ধতি দুর্বল শিক্ষার্থীদের বেশি আগ্রহী করে তোলে। এছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিং বা শিক্ষাবিষয়ক মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
আসুন জেনে নিই বহির্বিশ্বে দুর্বল শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষকেরা কী করেন?
বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে, দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কিছু উন্নত ও মানবিক কৌশল ব্যবহার করা হয়:
১. Individualized Education Plan(IEP):
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের অনেক দেশে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা শিক্ষানীতি (ওঊচ) তৈরি করা হয়, যেখানে তার প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনা করা হয়।
২. Inclusive Education:
দুর্বল শিক্ষার্থীদের সাধারণ শ্রেণিকক্ষে রেখেই বিশেষ সহায়তা দেওয়া হয়, যেন তারা বাদ না পড়ে।
৩. Special Education Teachers:
দুর্বল বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশিক্ষিত আলাদা শিক্ষক রাখা হয়।
৪. Peer Tutoring I Group Work:
সহপাঠীদের মাধ্যমে শেখানো হয়, যেন দুর্বল শিক্ষার্থীরা নিজেদের পিছিয়ে না মনে করে এবং বন্ধুত্বপূর্ণভাবে শেখে।
৫. Positive Reinforcement:
বহির্বিশ্বে শিক্ষকেরা ছাত্রদের সাফল্যের ছোট ছোট ধাপকে উৎসাহিত করেন্তযার মাধ্যমে তারা আত্মবিশ্বাস অর্জন করে।
৬. মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা:
অনেক স্কুলে পরামর্শদাতা (counselor) বা সাইকোলজিস্ট থাকে, যারা দুর্বল বা হতাশ শিক্ষার্থীদের সহায়তা করে।
দুর্বল শিক্ষার্থী পড়ানোর আন্তর্জাতিক কিছু নিয়ম:
*শিক্ষার্থীর দুর্বলতা চিহ্নিত করা –কোন বিষয়ে দুর্বল তা নির্ভুলভাবে নির্ণয় করতে হবে।
*ইনডিভিজুয়ালাইজড লার্নিং প্ল্যান (ILP) তৈরি করা –প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা শিক্ষা পরিকল্পনা।
*সহানুভূতিশীল মনোভাব –শিক্ষার্থীকে দোষ না দিয়ে সহানুভূতিশীলভাবে সহযোগিতা করা।
*সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহ দেওয়া– ক্লাসে প্রশ্ন করা, আলোচনা করা, কাজ করা–সবকিছুতে অংশ নিতে উৎসাহ দেওয়া।
*ছোট ছোট ধাপে পাঠদান –জটিল বিষয়কে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে শেখানো।
* চিত্র, চার্ট, অডিও–ভিজ্যুয়াল টুলস ব্যবহার –শেখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে বুঝতে সাহায্য করা।
* ইন্টার্যাক্টিভ ও গেম–বেইজড লার্নিং –মজার উপায়ে শেখার সুযোগ তৈরি করা।
* ঘন ঘন রিভিশন করানো –পূর্বে শেখা বিষয় বারবার ঝালিয়ে নেওয়া।
* পজিটিভ রিইনফোর্সমেন্ট –ছোট অর্জনের জন্যও প্রশংসা করে আত্মবিশ্বাস বাড়ানো।
* সহজ ভাষা ব্যবহার করা –কঠিন শব্দ বা বাক্য নয়, সহজ ও বোধগম্য ভাষা ব্যবহার করা।
* বন্ধুসুলভ পরিবেশ তৈরি করা– শিক্ষার্থী যেন ভয় না পায়, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা।
* মেন্টরিং ও কাউন্সেলিং সাপোর্ট –প্রয়োজন অনুযায়ী মানসিক সহায়তা দেওয়া।
* পারিবারিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা –অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা।
* রেগুলার ফিডব্যাক প্রদান –শিক্ষার্থীর অগ্রগতি সম্পর্কে নিয়মিত মতামত দেওয়া।
* ক্লাসে পার গ্রুপে কাজ করানো – অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে দেওয়া।
*রোল প্লে ও অ্যাকটিভ লার্নিং টেকনিক – শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণে শেখার পদ্ধতি অনুসরণ করা।
*সহজ হোমওয়ার্ক ও নিয়মিত চেকিং –সামর্থ্য অনুযায়ী হোমওয়ার্ক দিয়ে তা নিয়মিত যাচাই করা।
*সহানুভুতিশীল শিক্ষক নির্বাচন – যারা ধৈর্য ধরে ও ভালোবাসা দিয়ে শেখাতে পারে।
*সময়ানুযায়ী অগ্রগতি মূল্যায়ন– কীভাবে উন্নতি হচ্ছে তা নিরীক্ষণ করা।
* টেকনোলজি ব্যবহারে সহায়তা করা –শিক্ষার্থীর উপযোগী শিক্ষামূলক অ্যাপ, ভিডিও, বা অনলাইন টুল ব্যবহার করান।
সবশেষে বলা যায়, দুর্বল শিক্ষার্থী বলে কিছু নেই–আছে শুধু বৈচিত্র্যময় শেখার ধরণ ও গতি। পরিবার ও শিক্ষক যদি আন্তরিক হন এবং গবেষণা–ভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করেন, তবে যে কোনো শিক্ষার্থী সফলতার পথে এগিয়ে যেতে পারে।
লেখক : প্রভাষক ইংরেজি, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম