গতকাল ২৭ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব পর্যটন দিবস’ উদযাপিত হয়েছে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে। এ উপলক্ষ্যে প্রদত্ত এক বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, পর্যটন শিল্পের বিকাশের ফলে একদিকে আমাদের পর্যটন অঞ্চলগুলোর সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণেও সচেতনতা বাড়ছে। তিনি বলেছেন, পর্যটন খাতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশ। এই শিল্পের যথাযথ বিকাশ নিশ্চিত করতে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আমি আশা করি, পর্যটনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি পরিবেশগত অবক্ষয় রোধে সকলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল অবদান রাখবেন।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পর্যটন বর্তমানে বিশ্বজুড়ে টেকসই উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটন শিল্পের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি বলেন, আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, স্থাপত্য নিদর্শন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা, ঐতিহ্যবাহী খাবার ও অকৃত্রিম আতিথেয়তা যেকোনো দেশি–বিদেশি পর্যটককে আকর্ষণ করতে পারে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পর্যটনের এই অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে সচেষ্ট রয়েছে।
পর্যটন সম্ভাবনাময় অঞ্চলগুলোর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, স্থানীয় সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সম্পদের সঠিক ব্যবহার, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সমপ্রসারণ, সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক পরিহার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমাজের সব শ্রেণির জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, পর্যটন অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে সাহায্য করে। দেশের মোট জিডিপির শতকরা ৪ দশমিক ৪ শতাংশ আসে এই শিল্প থেকে। এই শিল্পকে উন্নত করে দেশের বেকারত্ব দূর করার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের ধারণা মতে বিপুল সংখ্যার পর্যটকদের ৭৩ শতাংশই ভ্রমণ করবে এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশ যদি এই বিশাল বাজার ধরতে পারে তবে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশের প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ পর্যটক দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ করে থাকে। দেশে ২০১৯ সালে পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল সবচেয়ে বেশি। যার ফলে ১৪০টি দেশের মধ্যে ১২৫তম স্থান থেকে ১২০ এ পৌঁছায়। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু পাকিস্তানই বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে। তবে পর্যটন আয়ের বেশিরভাগই আসছে দেশীয় উৎস থেকে। কেননা বিদেশী পর্যটকের কাছে আমাদের পর্যটন শিল্পের জনপ্রিয়তা এখনো অনেক কম। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সত্ত্বেও পর্যটন স্পটে রয়েছে অনেক দুর্বলতা। দীর্ঘ যানজটের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নেই পর্যাপ্ত হোটেলের সুব্যবস্থা। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে সুপরিকল্পিত আধুনিকায়ন ও শুল্কমুক্ত বিপণির অভাবও এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। বর্তমানে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সিএনএন, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মাধ্যমে পৃথিবীর নানা অঞ্চলের সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যসহ প্রাকৃতিক রূপ অবলোকন করা যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তেমন কোনো প্রচার নেই বললেই চলে। প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের কথা তুলে ধরার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান কিছুটা হলেও সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পর্যটনশিল্প বিকাশের অবারিত সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। বিভিন্ন উৎসবকালীন মানুষের ঘুরে বেড়ানোর যে প্রবণতা, তা এই অর্থনৈতিক বিকাশকে আরো বাড়িয়ে দেবে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটক আমাদের দেশে আসবে। বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ এই পর্যটন খাত থেকে আয় করা সম্ভব।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে বহু পরিব্রাজক ও ভ্রমণকারী মুগ্ধ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এই সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন সম্ভাবনা অপরিসীম। আমাদের রয়েছে সুবিশাল সমদ্রসৈকত, পাহাড়, অরণ্যঘেরা জলপ্রপাত, প্রত্নতত্ত্বের প্রাচুর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান, যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণসমৃদ্ধ অনন্য পর্যটন গন্তব্যে, যা বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে পর্যটকদের জন্য তীর্থস্থান হিসেবে। তবে পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে পর্যটন নিয়ে লেখালেখি ও ওয়ার্কশপ, সেমিনার, প্রদর্শনী বাড়ানো দরকার। সার্বিক অবকাঠামোর উন্নয়ন ছাড়া পর্যটনের প্রসার ঘটানো কঠিন হবে। বিশ্বের কয়েকটি দেশ একমাত্র পর্যটনকে অবলম্বন করেই সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করছে। আমাদের দেশে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঠিকমতো ও পরিকল্পিতভাবে করতে পারলে সুইজারল্যান্ড, পাতায়া, ব্যাংককের মতো ট্যুরিজম এখানেও গড়ে উঠতে পারে।