কক্সবাজারের চকরিয়ার হারবাং ছড়া খালে শ্যালোমেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে উত্তোলিত ভূ–গর্ভস্থ বালু পরিবহনের জন্য সংরক্ষিত বনের গাছ ও টিলা শ্রেণির পাহাড় সাবাড়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। প্রায় দুইমাস আগে তৈরি করা সেই রাস্তা দিয়ে প্রতিনিয়ত পরিবহন করা হচ্ছে অবৈধভাবে উত্তোলিত বালু। অভিযোগ ওঠেছে– খোদ বনবিভাগের সংশ্লিষ্ট বিট কার্যালয় এবং কর্মকর্তাদের নাকের ডগায় পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহতভাবে চলতে থাকলেও কোনো ধরনের আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এই অবস্থায় কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড অব্যাহতভাবে চলমান রয়েছে সংরক্ষিত বনের ভেতর।
সরেজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের চুনতি রেঞ্জের অধীনস্থ হারবাং বনবিট কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীণ হারবাং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর হারবাং কোরবানিয়া ঘোনা এলাকায় পরিবেশ বিধ্বংসী এই কর্মকাণ্ড চলছে গত দুইমাস ধরে। পরিবেশ বিধ্বংসী এই কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত একাধিক শ্রমিক দৈনিক আজাদীকে জানান, তারা দিনমজুর শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত হয়ে এখানে দৈনিক বেতনে কাজ করছেন। একদল শ্রমিক পার্বত্য অববাহিককার হারবাং ছড়ায় অবৈধভাবে শ্যালোমেশিন বসিয়ে ভূ–গর্ভের বালু তোলার কাজ করছেন। অপরদিকে আরেকদল শ্রমিক উত্তোলিত সেই বালু ট্রাকে তোলার কাজ করছেন। সেই ট্রাক বালুভর্তি হওয়ার পর সোজা পরিবহন করা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের ভেতর গাছ ও টিলা কেটে সমান্তরাল করা রাস্তা দিয়ে।
সংরক্ষিত বনের ভেতর এই রাস্তা তৈরি করতে কী পরিমাণ গাছ কাটা পড়েছে এবং সেই গাছ কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এমন প্রশ্ন করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শ্রমিক দৈনিক আজাদীকে বলেন, উত্তোলিত বালু পরিবহনের জন্য স্বাভাবিকভাবে কোনো সড়ক বা রাস্তা ছিল না। তাই সংশ্লিষ্ট হারবাং বনবিটের কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে বালু পরিবহন করার জন্য এই রাস্তা তৈরি করা হয়েছে প্রায় দুইমাস আগে।
শ্রমিকেরা আরও জানান, উত্তোলিত বালু পরিবহনের জন্য সংরক্ষিত বনের ভেতর রাস্তা তৈরি করতে হয়েছে অন্তত এক কিলোমিটারজুড়ে। এজন্য কাটা পড়েছে বনের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা মাঝারি সাইজের গর্জন গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির অন্তত হাজারো গাছ। আর কাটা পড়া বনের এসব গাছ আজিজনগরের কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক লক্ষ টাকা।
পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে কারা সম্পৃক্ত রয়েছেন তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেশ কয়েকজনের নাম ওঠে এসেছে। তারা হলেন– মৌলভী আলতাফ হোসেন, শহীদুল ইসলাম, মাহবুবুর রহমান প্রকাশ কালা মাহবুব, খানে আলম, সাজ্জাদুল ইসলাম, এমরানসহ শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, সংরক্ষিত বনের গাছ কেটে সড়ক তৈরি করার বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভী আলতাফ হোসেন ও শহীদুল ইসলাম দাবি করেছেন, তারা নিজেদের জমি থেকে বালু তুলছেন। আর সেই বালু পরিবহন করা হচ্ছে আগে থেকে সংরক্ষিত বনের ভেতর বিদ্যমান থাকা রাস্তা দিয়ে।
আপনাদের এই কাজে বনবিভাগের পক্ষ থেকে কোন ধরনের বাঁধা দেওয়া হয় কী–না এমন প্রশ্নে উভয়েই বলেন, আমরা বনবিভাগসহ স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করেই বালু উত্তোলনসহ তা বেচাবিক্রি করে যাচ্ছি। যেহেতু তাদের সাথে এই বিষয়ে বোঝাপড়া রয়েছে, সেহেতু আমাদের কাজে বাধা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
তবে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের চুনতি রেঞ্জের নিয়ন্ত্রণাধীন হারবাং বনবিট কর্মকর্তা মো. আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি এই বিটে যোগদান করেছেন মাত্র একমাস হচ্ছে। তাই আগে থেকেই সংরক্ষিত বনের ভেতর এই রাস্তা তৈরি করা হয়েছে বলে জানতে পেরেছেন। বিট কর্মকর্তা বলেন, সংরক্ষিত বনের ভেতর রাস্তা তৈরি, গাছ কাটাসহ বালু পরিবহনের বিষয়ে সরজমিন পরিদর্শনসহ ঘটনায় জড়িতদের তথ্য নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
চুনতি রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবির হাসান দৈনিক আজাদীকে বলেন, হারবাং বনবিটের নিয়ন্ত্রণাধীন উত্তর হারবাংয়ের কোরবানিয়া ঘোনায় সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে বালু পরিবহনের জন্য কাউকে অনুমতি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। যারা এই পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবদুল্লাহ আল মামুন দৈনিক আজাদীকে বলেন, সংরক্ষিত বনের ভেতর কেউ প্রবেশ করাটাও আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সেখানে হারবাং ছড়া থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন পরবর্তী তা পরিবহনের জন্য সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা তৈরির সঙ্গে যারাই জড়িত থাকবেন তাদের কাউকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে রেঞ্জ কর্মকর্তা এবং বিট কর্মকর্তাকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যারাই এই পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।