স্মৃতিতে উজ্জ্বল চবির বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ

ডেইজী মউদুদ | মঙ্গলবার , ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১:২৭ অপরাহ্ণ

তীরে তমালের ঘন ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদূর’ আর কবিতায় পড়া সেই বনলতা সেনের মতোই ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার প্রিয় বিভাগ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ। সবুজ প্রকৃতির অপূর্ব আবরণে সজ্জিত পাহাড়ের কোল ঘেঁষে লাল ইটের অসাধারণ এক স্থাপত্যে প্রতিষ্ঠিত আমাদের কলা ভবন। সেখানে সারি সারি জারুল হিজল তমাল আর চাপা ফুলের অপার হাতছানি। পারুল চম্পা আর গন্ধরাজের সুবাস নিয়েই কলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় আমাদের বাংলা বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ তম ব্যাচ আমি। কলেজের অঙ্গন পেরিয়ে ৭৯/৮০ সেশনে আমি যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বপ্রাঙ্গণে পা দিয়েছিলাম, সেদিন একদিকে ছিল অপার বিস্ময় আর অসীম আনন্দ! অন্যদিকে কিছুটা ভয়, আবার এর সাথে নতুন এক জগতের সাথে মোহনীয় পরিচয়। এত দিন যে মেয়েটি বালিকা স্কুল আর বালিকা মহা বিদ্যালয়ে পড়ে এসেছিল, সেই বালিকা আজ আধুলি না চাহিতেই হাতে যেনো চাঁদ পেলো!

এমন সহপাঠী পেলো, যে তখন ই খ্যাত কবি, সেই ই লিখেছিল, ‘বালিকা চেয়েছে চাঁদ, পেয়েছে আধুলি (কবি বিশ্বজিত চৌধুরী)। শুধু কি তাই কবিতে কবিতে ভরা, বিভাগের প্রথম বর্ষ থেকে এম এ শেষ বর্ষ পর্যন্ত। গানের শিল্পী, নাচের শিল্পী, ছড়াকার, গল্পকার, আবৃত্তিকার এর সরব পদচারণা! বালিকা হতবাক! জগতের এই আনন্দযজ্ঞে যেনো তার প্রতিদিনই আমন্ত্রণ। আর বিভাগের শিক্ষক মণ্ডলীতো এক একটি উজ্জ্বল তারকা। নভোমন্ডলে যে ভাবে নক্ষত্র আর গ্রহ তারা দ্যুতি ছড়ায়, শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞান চর্চায়, ব্যক্তিত্বে, মাধুর্যে চলনে বলনে উনারা ছিলেন চৌকষ আর দীপ্তিময়। ডক্টরেট ডিগ্রীতে ভরা ডিপার্টমেন্ট। সব শিক্ষকই সাহিত্যের সকল বিষয়ে প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ আর জ্ঞানের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। আনিসুজ্জামান স্যার, মনিরুজ্জামান স্যার, দিলোয়ার হোসেন স্যার, শামসুল আলম স্যার (আমার দুলাভাই), রশীদ আল ফারুকী স্যার, শাহজাহান মনির স্যার, জহুরুল হক স্যার, খালেদা হানুম আপা, সুলতান আহমেদ ভুঁইয়া স্যার, শিপ্রাদি, রাজীব হুমায়ুন স্যার, ভুইয়া ইকবাল স্যার, পারুল আপা আর ময়ুখ স্যার। চিন্তা করে দেখেন, আমাদের শিক্ষকমণ্ডলী কারা ছিলেন। আমরা কত ভাগ্যবান এরকম সব বিষয়ে বিজ্ঞ আর পণ্ডিত শিক্ষকদের পেয়েছিলাম। প্রথম বর্ষ অনার্সের প্রথম ক্লাস ছিল আনিসুজ্জামান স্যারের। ১২১ নম্বর রুমে সকাল ৮.৪৫ এ। স্যারের ক্লাশ ধরার জন্য ভোরে উঠেই বিআরটিসি বাস ধরার কী প্রতিযোগিতা। বেশির ভাগ সময় ব্রেকফার্স্ট না করেই ছুটতাম। সাড়ে ৭ টার বাস। আমাদের বাসা ছিল প্যারেড এর কোণায়। চিটাগাং কলেজের হোস্টেল গেটে সিরাজ উদ দৌলাহ রোডে। চিটাগাং কলেজ দিয়ে ঢুকে উত্তর পাশে এসেই বাসে উঠতাম। প্রায় সময় সিট পেতাম না। দরজার সিঁড়িগুলো ইংরেজি বিভাগের সুন্দরী এবং স্মার্ট মেয়েগুলোর দখলে থাকতো। অগত্যা লোকাল বাসেই চেপে ভার্সিটির ১ নম্বর গেটে। গেট থেকে আবার রেল গেট পেরিয়ে চবির বাসে করে ডাইরেক্ট আমাদের কলা ভবনে নেমেই ১২১ নম্বর রুমে। গেটে স্যারের অরেঞ্জ কালারের গাড়ি দেখেই বুঝতাম, এক টু পরেই স্যার এসে পরবেন। তিনি আমাদের বঙ্কিমচন্দ্রর ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ পড়াতেন। কী অসাধারণ পাঠদান শক্তি। যিনি স্যারের ক্লাশ পাননি, তিনি তা বুঝবেন না কোন দিনও। উনার ক্লাশ করে আর ঘরে এসে পড়তে হতো না। তিনি ‘কালান্তর’ পড়িয়েছেন, রক্তকরবী পেরিয়েছেন, পড়িয়েছেন ইডিপাস। এসব আমাকে আর দ্বিতীয়বার পড়তে হয়নি।এতো গেলো অনার্স এর কথা। আর মাস্টার্সে তিনি বঙ্কিম চন্দ্রের ১২ টি উপন্যাস লাইন বাই লাইন পড়াতেন। উপনাসের বেশির ভাগ লাইন এখনো আমার মুখস্থ! স্যারের উপস্থাপনা অসম্ভব সাবলীল আর প্রাঞ্জল, বুঝতে সহজ শুনতে শ্রুতিমধুর অথচ জ্ঞান গর্ভ। আর মনিরুজ্জামান স্যার কী স্মার্ট, কী সুন্দর, পড়াতেন বিদেশী স্টাইলে। প্রথম বর্ষে তিনি বিহারীলাল পড়াতেন। ক্লাশে প্রবেশ করে ‘গুড মর্নিং বলে শুরু করতেন’ সর্বদাই হু হু করে মন/ বিশ্ব যেনো মরুর মতন।’ আধুনিক বাংলা কবিতায় রোমান্টিসিজম এর সূচনা চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দিতেন। পরে তিনি আমাদের ধ্বনিতত্ত্ব আর ভাষাতত্ত্ব পড়াতেন। এনি কোয়েশ্চন? বলেই ক্লাশ শেষ করতেন। সুলতান আহমেদ ভুইয়া স্যার পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনা কালে হাসতে হাসতে শেষ। পদ্মাবতীর ঠোঁট এতই লাল ছিল, তার পরশেই পান লাল হয়ে গেলো!’ তাম্বুল রাতুল হৈল অধর পরশে’। অন্যদিকে গায়ের রং এত স্বচ্ছ, পেটের নাড়িভুড়িও বাকি দেখা যেতো।

এদিকে খালেদা হানুম আপা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এ রাধিকার বিরহ বর্ণনায় ‘কে না বাঁশী বা এ বড়াই কালিনী নঈ কূলে’ এই পদ টি যেনো এখনো কানে বাজে। আর রশীদ ফারুকী স্যার এতো মজার মানুষ ছিলেন, ভারত চন্দ্র রায় গুণাকর পড়াতে গিয়ে শিব আর পার্বতীর ঝগড়া যখন বোঝাতেন অনেক রসিকতা করতেন। ‘কূ কথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠ ভরা বিষ/ কেবল আমার সাথে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ’ এসব চরণ স্যারের পড়ার জৌলুসে এখনো আমি ভুলিনি। জহুরল হক স্যার নাটক আর ছন্দ পড়াতেন। ইতিহাস পড়াতেন শাহজাহান মনির স্যার, আর দিলোয়ার স্যার ভাবের জগতের মানুষ। তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়াতেন।

যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে কিংবা ‘সন্ধ্যা রাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানিযেনো মেঘে ঢাকা বাঁকা তলোয়ার’ আসলে সব শিক্ষকদের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। আর দুজন শিক্ষক যারা, এক টু ডিফারেন্ট ছিলেন উনাদের নিয়ে খানিক টা বলবো। আমরা যখন ভর্তি হয়েছি তখন অপেক্ষাকৃত বয়সে নবীন ছিলেন রাজীব হুমায়ূন স্যার। তিনি আমাদের পড়াতেন বৈষ্ণব পদাবলী, বনলতা সেন আর মেঘদূত। ক্লাশে নাটকীয় ভঙ্গীতে প্রবেশ করেই, বোর্ডে লেখা শুরু করতেন স দাই ধেয়ানে, চাহে মেঘ পানে না চলে নয়ান তারা / বিরতি আহারে রাংগা বাস প্‌ রে যেম তি যোগিনী পাড়া’। এর পর জিজ্ঞেস করতেন, বলো এটি কার পদ। ফলে উনার ক্লাশে আমাদের উত্তর দেয়ার মতো প্রস্তুতি নিয়েই যেতে হতো। আর মেঘদূত আর বনলতা সেন পড়াতে গিয়েই কালিদাশ আর জীবনানন্দ কে আমাদের চেতনার সঙ্গে, আমাদের শিরা উপশিরায় বেঁধে দিয়েছিলেন। উনার পড়ানোর স্টাইলই ছিল অন্যরকম। পরে তিনি আমাদের সমাজ ভাষা বিজ্ঞান আর জীবন্যনন্দ দাশ পড়াতেন। আর ময়ুখ স্যার সে তো আরেক প্রজাতির! যে বিষয়ে পড়াবেন সেখান থেকে উড়াল দেবেন একেবারে বিশ্বব্রহ্মান্ডে! চর্যাপদ থেকে সাহিত্য। সেখান থেকে পুরাণে, পুরাণ থেকে দর্শনে, সেখান থেকে রিলকে, নীটশে কে ছাড়িয়ে একেবারে দস্যু বনহুর ও বাদ যায় না। তিনি রবীন্দ্রনাথ, সুধীন দত্ত, নজরুল এবং শামসুর রাহমান পড়াতেন। এসব পড়াতে পড়াতে তিনি বিষয়ের বাইরে গিয়ে বিশ্বময় পরিভ্রমণ করতেন। কোন আলসেমি বা বিরক্ত হতেন না। তবে বাকপটু ছিলেন তাই কথার বাণেই জর্জরিত করতেন। সেই বাণে কেউ আহত হতো না, সব বিষয়ে জ্ঞাত হতো। এবার আমাদের সতীর্থ দের কথায় আসি। কবি, গানের শিল্পী আর লেখকে সমৃদ্ধ এই বিভাগ। বারো মাসে তেরো পার্বণ। কালচারাল অনুষ্ঠান, আবৃত্তি, রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী, নবীন বরণ, বিদায় অনুষ্ঠান সব সময়। আবার কোলকাতা থেকে আসতেন বড় বড় শিল্পী সাহিত্যিক। প্রদীপ ঘোষের একক আবৃত্তি এখনো ভুলতে পারি না। আমাদের অনার্সের মৌখিক পরীক্ষায় এক্সটারনাল ছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল সার। আর মাস্টার্স এ ছিলেন ড. মুস্তফা নুরুল ইসলাম স্যার। এনাদের পরীক্ষক হিসেবে পাওয়া আমাদের জীবনের এক বিশাল মাইলস্টোন।

আমাদের অগ্রজরা তো বটেই, অনুজ রাও এখন যশে খ্যাতিতে পূর্ণ। আমাদের বিভাগের চবিয়ানদের দেখলে অন্য রকম এক অনুভুতির অনুরণন হয়। আমাদের বিভাগের করিডোর, সেমিনার কক্ষ, সেই আলম ভাই, পিয়ন সুনীল দা, স্টেনো রশীদ ভাই সবাইকে খুব মনে পড়ে, সহপাঠীদের সাথে এখনো যোগাযোগ আছে। তবে কাউকে বেশি বেশি পাই। ওবার অনেক কে পাই না। ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা চাই তাহা পাই না’ এটিই বাস্তব। আমাদের অনুজ আনোয়ার সাঈদ পলাশ এখন বিভাগের চেয়ারম্যান। ওর কাছে শুনলাম ডিপার্টমেন্ট নাকি নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে। আহা! আমাদের মজার মধুর স্মৃতির অলিন্দ তো আর পাবো না। পলাশ: ইনভাইট করলো। যাবো একদিন। কিন্তু কোথায় যাবো? সেই পদ চিহ্ন রেখা তো নেই এখানে। সেই ইট পাথর আর কং ক্রিট আমাদের দেখলে বলবে ‘কোথায় চলেছো? ছুটবে বা আর কতো, /উদাসীন বালি ঢাকবে না পদ রেখা/ প্রাক পৌরাণিক বাল্যবন্ধু যতো, বিগত সবাই আমি অসহায় একা’।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের লোকসাহিত্য
পরবর্তী নিবন্ধঅগ্নিযুগের বিপ্লবতীর্থ: ইউরোপীয়ান ক্লাব