বিশ্ব বাণিজ্যে যে দেশ যত বেশি বৈচিত্র্যময় ও অপ্রচলিত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করতে পারবে সে দেশ তত বেশি এগিয়ে যাবে। সে লক্ষে বিভিন্ন দেশ এখন রপ্তানি বাণিজ্যে বৈচিত্র্য আনার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে পিছয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বেশ কিছু পণ্য রপ্তানির সুযোগ থাকার পরেও সরকারি নানান জটিলতায় তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেই ধরনের কয়েকটি পণ্য নিয়ে আজকের আলোচনা:
১। বাংলাদেশের মানুষের খুব প্রিয় খাবার গরুর মাংস। প্রতিবছর দেশে এক কোটির বেশি গরু জবাই করা হয়। যার মধ্যে ৫০ লক্ষ ষাঁড়। গরু জবাই শেষে চামড়া ও মাংস সংগ্রহের পর অবশিষ্টাংশ ফেলে দেওয়া হয়। তবে পশুর যৌনাঙ্গ, রক্ত, হাড়, শিং, ভুঁড়ি, লেজের লোম ও চর্বি কোনো কিছুই ফেলনা নয়। সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের রয়েছে নানা ব্যবহার ও বাণিজ্যিক মূল্য। তার মধ্যে গরুর লিঙ্গের রয়েছে প্রচুর চাহিদা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পশুর যৌনাঙ্গ দিয়ে তৈরি হয় কুকুরের পুষ্টিকর খাবার। সেই চাহিদাকে সামনে রেখে বিগত কয়েক বছর ধরে রপ্তানি হচ্ছে গরুর লিঙ্গ (বুলস্টিক)। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রায় ২০ কোটি টাকার ও ২০২২–২৩ অর্থবছরে ৩৮ কোটি ৬০ লাখ টাকার ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫৩৭ কেজি বুলস্টিক রপ্তানি হয়, যার ৯৫% গরুর। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের মে মাসে ৩ কোটি ৮৫ টাকা মূল্যের ১৪ হাজার ৭৫২ কেজি বুলস্টিক রপ্তানি করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় রপ্তানি হচ্ছে। যার মধ্যে ৬০% যায় যুক্তরাষ্ট্রে বাকি ৪০% কানাডায়। মান ও প্রকারভেদে প্রতি কেজি বুলস্টিকের দাম ১৮ থেকে ৩৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত, যা মাংসের দামের চেয়ে অনেক বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে আগে ১০–১৫% প্রণোদনা থাকলেও এখন তা কমে নেমে এসেছে ৬%।
বিশ্বে এ ধরনের অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানিতে এগিয়ে ব্রাজিল ও তুরস্ক। তবে এই পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। জানা যায় রপ্তানির জন্য বুলস্টিক সংগ্রহের প্রক্রিয়া হিসেবে প্রথমে গরু জবাইয়ের পর লিঙ্গ সংগ্রহ করে ফ্রিজারে রাখতে হয়। পরে ভালোভাবে ধুয়ে চামড়া ও চর্বি সরিয়ে বুলস্টিক আলাদা করতে হয়। তারপর সেটির মূত্রনালি আলাদা করে আবারো পরিষ্কারের পর রোদে শুকানো হয়। যদিও সূর্যের আলোতে শুকালে আক্রমণ করতে পারে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া। তাই বাণিজ্যিক ওভেনে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ৬০ মিনিট ধরে শুকালে এই পণ্য প্রস্তুত হয়ে যায়। তবে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী এই পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হয়। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, শুকানোর ক্ষেত্রে আর্দ্রতা ৫–১০% মধ্যে থাকা জরুরি। পণ্যটি রপ্তানির উপযোগী হওয়ার পর সংগ্রহ করা হয় স্বাস্থ্যসনদ ও রপ্তানির ছাড়পত্র। রপ্তানির জন্য প্রতিটি বুলস্টিক নির্দিষ্ট ওজন ও আকৃতি অনুযায়ী কেটে ভ্যাকুয়াম প্যাকিং করে রপ্তানি করতে হয়। বর্তমানে দেশের প্রায় সব জেলা থেকে গরু ও মহিষের বুলস্টিক সংগ্রহ করেন মধ্যস্বত্বভোগীরা।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যটি রপ্তানি করতে জীবাণুনাশক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গামা রেডিয়েশন করতে হয়। এই কাজটি করে সাভারে অবস্থিত পারমাণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেখানে এক টন পণ্য পাঠালে কাজটি করতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। এ ছাড়া গরু জবাইয়ের আগে বিএসই (বভিন স্পঞ্জিফর্ম এনসেফ্যালোপ্যাথি বা ম্যাডকাউ ডিজিজ) সার্টিফিকেট প্রদান করলে এই পণ্য ইউরোপের বাজারেও রপ্তানি করা সম্ভব। ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করতে পারলে রপ্তানি বেড়ে দ্বিগুণ হবে। শুধু গরুর বিশেষ অঙ্গ নয়, নাড়ি–ভুঁড়ি, হাড়, চর্বি এবং পাকস্থলী (ওমাসম) রপ্তানি করে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। এসব অঙ্গ মূলত চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতে ওষুধ, কুকুরের খাবার এবং স্যুপ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
২। অপ্রচলিত আরেকটি পণ্য হলো কুমিরের মাংস ও চামড়া। যেটি আইনি জটিলতার কারণে রপ্তানি করা যাচ্ছে না। অথচ উদ্যোক্তারা কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে দেশে দুটি খামার স্থাপন করেছেন। যাতে রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকের লোন। তবে এভাবে চলতে থাকলে খামারগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে এবং লোনের টাকা আদায় হবে না। এর একটি হলো বান্দরবানের তুমব্রু পাহাড়ে। যেখানে রয়েছে ছোট–বড় মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার কুমির। আকিজ ওয়াইল্ডলাইফ ফার্ম লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২৫ একরের জায়গায় এটি স্থাপন করে। খামারটি ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে ৫০টি লোনাপানির কুমির এনে এখানে প্রজনন কার্যক্রম শুরু করা হয়। ৫০টি কুমিরের মধ্যে স্ত্রী কুমির ছিল ৩১টি। গত ১৪ বছরে কুমিরগুলোর ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হয়েছে। বর্তমানে খামারটিতে ছোট–বড় মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার কুমির রয়েছে, যার মধ্যে এক হাজারের বেশি রপ্তানিযোগ্য হলেও আইনি জটিলতায় এক যুগ ধরে রপ্তানি করা যাচ্ছে না। ফলে খামারটির অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
জানা যায়, সরকারের অনুমতি পেলে কুমিরগুলো রপ্তানি করা হবে। রপ্তানির জন্য কুমিরের ওজন ২০ থেকে ২৫ কেজি এবং লম্বায় ৫ ফুট হতে হয়। খামারে বর্তমানে এমন কুমিরের সংখ্যা ১ হাজারের বেশি। বিদেশে কুমিরের প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হয় ৩০ ডলারে। সে হিসাবে প্রতিবছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার সুযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে ময়মনসিংহের ভালুকায় বাণিজ্যিক ভাবে চাষ হচ্ছে কুমির। রেপটাইলস নামে এ ফার্মে পরম যত্নে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বড় হচ্ছে কুমির, বাড়ছে সংখ্যা। রপ্তানিমুখী এ কুমির খামার এখন শুধু ভালুকার নয়, দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০০৩ সালে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪ একর জমির ওপর মেজবাহ উল হক ও মোস্তাক আহমেদ নামে দুই ব্যবসায়ী খামারটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৪ সালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সিআইটিআইইএস’র ছাড়পত্র পেয়ে মালয়েশিয়া থেকে ৭৫টি কুমির আমদানি করে খামারটি। ২০১০ সালে প্রথম দফায় ৬৭টি হিমায়িত কুমির জার্মানিতে রপ্তানি করে খামারটি আয় করে দেড় কোটি টাকা। ২০১২ সালে আর্থিক প্রয়োজনে খামারের মালিকানা হস্তান্তর করেন বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের কাছে। এরপর থেকে খামার দেখিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ বের করে নেন পিকে হালদার। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১,৫০৭টি কুমিরের চামড়া জাপানে রপ্তানি করে আয় হয় সাড়ে ৭ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে অর্থ কেলেঙ্কারিতে পিকে হালদার জড়িয়ে পড়ায় এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করায় খামারটিতে অচলাবস্থা দেখা দেয়। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন বন্ধসহ চরম অব্যবস্থাপনায় কুমিরের খাদ্য সংকট দেখা দেয়।
আর্থিক সংকট ও মালিকানা জটিলতায় ২০২০–২১ সালে প্রায় ১৫০০ কুমির মারা যায়। পরে বিষয়টি নিয়ে একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর উচ্চ আদালত খামারটি পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. নাইম আহমেদকে চেয়ারম্যান ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুমির বিশেষজ্ঞ এনামুল হককে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং আরো চারজনকে পরিচালক করে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেন। এ বোর্ড ২০২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিত খামারের কার্যক্রম শুরু করে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এনজিও ‘উদ্দীপন’ খামারটি কিনে নেওয়ার পর থেকে খামরটিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে।
জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে কুমিরের চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁত চড়া মূল্যে বিক্রি হয়। ফ্রান্স,চীন, জার্মানি, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতিটি কুমিরের চামড়া ৫০০–৬০০ ডলার মূল্যে রপ্তানি করা হয়। এ খামার থেকে কুমিরের চামড়া রপ্তানি করা হলেও কুমিরের মাংস, হাড় ও মাথা রপ্তানির অনুমতি নেই। একটি কুমিরের সবকিছু রপ্তানি করা গেলে আয় কয়েকগুণ বাড়বে।’
সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির পর পরাশক্তি হিসাবে চীনের উত্থানের পিছনে রয়েছে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি। তারা আলপিন থেকে উড়োজাহাজ সবকিছু উৎপাদন ও রপ্তানি করে। এখনো তারা সর্বোচ্চ সক্ষমতা প্রয়োগ করে বিভিন্ন প্রচলিত ও অপ্রচলিত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি অব্যাহত রেখেছে। ফলে ২০০৯ সাল থেকে তারা বিশ্বের বৃহত্তম পণ্য রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং বিগত ১৬ বছর এই অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০২৩ সালে চীনের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩.৫১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাই অর্থনৈতিক উন্নতি করতে হলে বাংলাদেশকেও বিভিন্ন প্রচলিত ও অপ্রচলিত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারকে সব ধরনের বিধিনিষেধ বিলুপ্তসহ রপ্তানি নীতিমালা সহজিকরণ করতে হবে। দেশজ পণ্যে রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রণোদনা বাড়াতে হবে। আর এটি করতে হবে অতি শীঘ্র ও দ্রুত এবং এতে কোনভাবেই সময় ক্ষেপণ করা যাবে না। লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক।