শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র সংসদের প্রয়োজনীয়তা

মোয়াজ্জেম হোসেন | রবিবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের নিজেদের অধিকার চাওয়ার অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম হল ছাত্র সংসদ। ছাত্র সংসদ হলো কোন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম পরিচায়ক। জ্ঞানার্জনের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ চলবে ছাত্রশিক্ষকের পারস্পরিক সহযোগিতায়। আর এ সহযোগিতার জন্য চাই ছাত্র প্রতিনিধিত্ব, যারা ছাত্রদের দাবী দাওয়া নিয়ে কথা বলবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে। এ প্রতিনিধিত্ব করাই ছাত্র সংসদের প্রধান কাজ। এটি শিক্ষার্থীদের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করে। ছাত্র সংসদ হচ্ছে এমন একটি কার্যনির্বাহী পরিষদ যেটি ছাত্রদের মধ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান ও দাবি দাওয়া আদায়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

ছাত্র সংসদ হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার কোন একক রাজনৈতিক ব্যানার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রদের ভোটে প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। ছাত্র সংসদের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছেশিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ত্বরান্বিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একাডেমি ও একাডেমির বাইরের বিষয়ে সর্বোচ্চ সুবিধা অর্জন করা, নেতৃত্ব বিকাশে এবং সত্যিকারের নাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা। এ প্রধান চারটি কাজ ছাড়াও ছাত্র সংসদের অধীনে জার্নাল বুলেটিন, পত্রিকা প্রকাশ, বিতর্কের আয়োজন, গান, আবৃতি, খেলাধুলার আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসে ছাত্র সংসদের রয়েছে এক গৌরবময় ভূমিকা। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলন ও ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। এ ছাড়াও সর্বশেষ ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে দেশের সংকটময় মুহূর্ত ও ক্রান্তিকালে এগিয়ে এসেছে এ দেশের ছাত্র সমাজ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ন্যায্য দাবি দাওয়া থাকে শিক্ষার্থীদের। এ সকল যৌক্তিক দাবি আদায়ে ছাত্র সংসদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নেতৃত্ব দিতে ছাত্র সংসদের ভূমিকা অপরিসীম। এটি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার মাধ্যমে সমাজের উন্নতি, শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ ও নেতৃত্বের উন্নয়ন ঘটায়।

ছাত্র রাজনীতি মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের রাজনীতি হলেও এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি দেশকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য উৎকৃষ্ট নেতা তৈরি করা। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনীতি চর্চার চেয়ে অপচর্চাই বেশি দেখা যাচ্ছে।

প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হচ্ছে অস্বাভাবিক নির্যাতন। যেমন: সিনিয়রজুনিয়র সম্পর্ক, ট্যাগিং, র‌্যাগিং, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজী, সিট দখল, মাদক সন্ত্রাস, শারীরিক হেনস্তা, মানসিক নির্যাতন, সামাজিক অবমাননা ইত্যাদি। এমন অনেক ঘটনা আছে, শুধু রাজনৈতিক মত পার্থক্য হওয়ার কারণে অনেক ছাত্র হত্যার শিকার হয়েছে। যার চিত্র প্রতিনিয়ত আমাদের চোখে পড়ছে। খুব বেশি আলোচিতসমালোচিত না হলে এমন হাজারো গল্প থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালেই। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের লেজুড় ভিত্তিক ছাত্র সংগঠনের অবৈধ প্রভাব বিস্তারে অনেক সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা রীতিমত অসহায়ত্ববোধ করে। ক্ষমতাসীন দল সবসময় তাদের ছাত্র সংগঠনকে ক্ষমতা দখলের রাখার পাওয়ার হাউজ হিসেবে ব্যবহার করে। ক্ষমতাসীন দলের গদি টিকিয়ে রাখতে সাধারণ ছাত্রদের অনেক ক্ষেত্রে জিম্মি করে অপরাধমূলক কার্যক্রমে বাধ্য করে। বিভিন্ন অপকর্মের দ্বারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলার কারণে গণতান্ত্রিক উপায়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা নষ্ট করে ফেলে, বাধ্য হয়ে ক্ষমতাসীন দল কখনো চাই না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক। তাই বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এতদিন ছাত্র সংসদ কার্যকর ছিল না। নতুন প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা। এতে বাংলাদেশ হারাচ্ছে মেধাবী কর্মঠ ছাত্রনেতা।

অতীতে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তাদের ছাত্রজীবন থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। সেই সংগঠনগুলো হলো ডাকসু, রাকসু, চাকসু। যে সংগঠনকে বলা হয় নেতৃত্ব তৈরির সূতিকাগার। কারণ ছাত্র সংসদে সাধারণ ছাত্রদের নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমেই একজন ছাত্র হয়ে ওঠতে পারেন তুখোড় নেতা। তখন তিনি দেশের জন্যও নেতা বনে যেতে পারেন যার উদাহরণ আমাদের মাঝে এখনও বিদ্যমান। বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছে, সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি হলেও ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। চাকসু এবং রাকসুতেও তফশীল ঘোষণা করা হয়েছে, আশা করছি নির্ধারিত তারিখে নির্বাচনও সম্পন্ন হবে। সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে যারা বিভিন্ন কর্মসুচির মাধ্যমে দলগতভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তাদেরকে সাধারণ ছাত্ররা প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছে। আজকের শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি তথ্যপ্রবাহের মধ্যে বেড়ে ওঠছে। তাই এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের চটকদার বক্তব্য, বিবৃতি ও কথা বলে আশ্বস্ত করা যাবে না।

ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা যেসব সমস্যা ভোগেন, বিশেষ করে আবাসন সমস্যা, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, ছাত্রদের কল্যাণভিত্তিক রাজনীতি, ছাত্রদের শ্বার্থ, মানসম্মত শিক্ষা, নিরাপদ ক্যাম্পাস ও ছাত্রদের ক্যারিয়ার গাইড লাইন ইস্যু, অসচ্ছল ছাত্রদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার ক্ষেত্র নিয়ে যারা অগ্রণী ভুমিকা পালন করবে, তাদেরকেই সাধারণ শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে দেবে। মোদ্দাকথা, সাধারণ শিক্ষার্থীরা যাদের উপর আস্থা রাখতে পারবে তাদেরকে নির্বাচিত করবে। প্রত্যেকটি নির্বাচিত ছাত্র সংসদের উচিত রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি না করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছাত্রীদের যৌক্তিক দাবী আদায়, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও শিক্ষাঙ্গনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা।

সুস্থ রাজনীতি চর্চার অভাবে ছাত্র সমাজের মধ্যে দেশপ্রেম, পরার্থপরতা, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। এই তরুণরা সহজেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং এমনকি জঙ্গিবাদের মতো ভয়ঙ্কর পথেও পা বাড়াচ্ছে। এই অবক্ষয় দূর করে ছাত্রসমাজকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই, এরাই পরবর্তীকালে সকল অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারবে। আর এজন্য প্রয়োজন সকল কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে, শিক্ষার্থীদের হাতে নেতৃত্ব গেলে; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিরাজমান অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে। ছাত্রসংসদ এবং ছাত্র রাজনীতি রাজনৈতিক দলের কল্যাণে না হয়ে হোক ছাত্রদের কল্যাণে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনীতির ক্ষেত্র না হয়ে হোক শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্র।

লেখক: প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ