দেশ হতে দেশান্তরে

পাওয়ার অব পজিটিভ থিংকিং

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

বোঝা যাচ্ছে চামড়া যথেষ্টই মোটা হয়েছে। আজকাল এসব আর তেমন গায়ে লাগে না। কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে, আমাকে কেন্দ্র করে যে ঘটনার উদ্ভব, সেটির দায় তো গিয়ে পড়ছে এইচ আর হেড গিউসি আর বস ফিলের উপর! যদিও তেমন সিরিয়াস মনে না হওয়ায় ব্যাপারটি অফিস থেকে বেরুবার মুহূর্তেই হাসতে হাসতেই জানিয়েছে, গিউসি। সিরিয়াস হোক আর না হোক, আমার কারণে অন্য কেউ বেহুদা প্রশ্নের মুখোমুখি পড়বে এ মেনে নিতে পারি না আমি। সেজন্যই মূল ব্যাপারটি গায়ে না লাগলেও গিউসি ও ফিলের জন্য খচ খচ করছে মন। ঘটনা হলো, কিছুকাল আগে এই সৌদি অফিস থেকে আমাদের হেড কোয়ার্টারের বিজনেস প্র্যাক্টিস অফিসে বেনামে একটা চিঠি গিয়েছে এখানকার রেইসিজম নিয়ে!

আমাদের ঐ বিজনেস প্র্যাক্টিস অফিসে, যে কেউ, যে কোন সময়, সরাসরি জানাতে পারে তাদের যে কোন ক্ষোভ। ঐ অফিসের মূল কাজ, বিশ্বজুড়ে কোম্পানির নানান অপারেশনসে অনৈতিক কোন প্র্যাক্টিস হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে তদারকি, খবরদারি করা। তবে শুধুই যে ব্যবসায়িক প্র্যাকটিসের অনৈতিকতা নিয়ে তারা কাজ করে, তা নয়। কোম্পানির কোন পলিসির ব্যত্যয় কোথাও ঘটলেও, যে কেউ তা তাদের গোচরে আনতে পারে। কোন অভিযোগ পাওয়ার পর, ওখানকার দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি মনে করেন প্রাপ্ত অভিযোগের গ্রহণযোগ্যতা নাই, বা তেমন গুরুতর কিছু না ওটা, তবে সেটিকে সরাসরি সংশ্লিষ্ট দেশের কান্ট্রিহেডের কাছে পাঠিয়ে দেয় ওরা। এক্ষেত্রেও ঘটেছে সেটাই। আর ফিল চিঠিটি পেয়েই ঐটি গিউসিকে ফরওয়ার্ড করতেই, গিউসি আমাকে জানিয়েছে তা, কারণ ঘটনাটির বিষয়ে জড়িয়ে আছি আমি।

আর সে ঘটনা হচ্ছে, রিয়াদের এই অফিসটির গাড়ী পার্ক করার জায়গা অত্যন্ত সীমিত। আমাদের ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানি সাফাদ এই দালানের মালিক হওয়ায় স্বভাবতই তারা তাদের কর্মকর্তাদের জন্য বেশীরভাগ পার্কিংয়ের জায়গা নিয়ে নেবার পর, মাত্র চারটি স্পট জুটেছে আমাদের অফিসের কপালে। ফলে সেই শুরু থেকেই এখানকার অফিসিয়াল প্র্যাক্টিস হল, ঐ পার্কিংগুলো এই অফিসের কান্ট্রি হেড, মার্কেটিং হেড, সি এফ ও এবং এইচ আর হেড এই চারজনের জন্য বরাদ্দ। সেই হিসাবে আমিও পেয়েছি একটা পার্কিং স্পট নিতান্তই পদাধিকার বলে চলতি প্র্যাক্টিস অনুসরণ করে।

কিন্তু এই যে আমি একদম হালনাগাদ এসে পেয়ে গেলাম একটা পার্কিংস্পট এটি নিশ্চয় পছন্দ হয়নি কারো কারো। তাই ব্যাপারটিতে এন্টিসৌদি রেইসিজমের গুড় লাগিয়ে, অভিযোগ করেছে কেউ জায়গা মতো! অথচ ঘটনা তো হল উল্টা। অহরহই তো আমি নিজেই মিসকিন হিসেবে এখানে রেইসিজমের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি, ঘরে বাইরে। ঘরে ব্যাপারটি আড়ালে আবডালে ঘটলেও, বাইরে তো ওটার মুখোমুখি হয়েছি সরাসরি।

ব্যাপারটি যতোই গিউসি হাসতে হাসতে বলুক না কেন, তার সেই হাসিকে আমার কষ্টকল্পিতই মনে হয়েছে। এদিকে বেনামি সেই চিঠিটির ব্যাপারে গিউসির সন্দেহের তীর সরাসরি ফাহাদ আল হিন্দির দিকে তাক করা। কারণ সে ই কিছুদিন আগে আড়ালে আবডালে আমাকে মিসকিন ডাকার অপরাধে, তুমুল ধমক খেয়েছিল ফিলের কাছে।

ওন্যদিকে, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এবারের এ ব্যাপারটি অবশ্যই ফাহাদ ঘটায়নি। ঘটিয়েছে অন্য কেউ। এতে সাথে সাথেই মনের ভেতরে ভেসে উঠলো সম্ভাব্য যে তিন চারটা মুখ, তার কোনটাই সৌদিদের নয়!

নাহ, থাক। ওসব নিয়ে আর না ভাবি। পেশাগত জীবন শুরু করার কিছুকাল পর থেকে নানান সময়ে “পাওয়ার পজিটিভ থিংকিং” সম্পর্কে শুনে শুনে সেটি যে কবে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল নিজের অবচেতনে তা জানি না। তবে সেই থেকেই তো সেটি প্র্যাক্টিস শুরু করেছিলাম নিজে যেমন একদম কায়মনে, তেমনি সেই বয়ানই তো দিয়ে থাকি আমি সুযোগ পেলেই ঘরে বাইরে, প্রায়শ। অতএব নেই এখনো সেটিরই শরণ। এ ভাবনায়, পার্কিং লট থেকে গাড়ী বের করতে করতে ভাবতে শুরু করলাম, বেশ কিছু ভাল ঘটনাই তো ঘটেছে গত কয়েকদিনে। এই যেমন গাড়িটা পেয়েছি ফিরে ডিস্ট্রিবিউটরের ওয়ার্কশপ থেকে, নিয়ে যাবার তিন দিন পর একদম ঝকঝকে তকতকে অবস্থায়। অন্য কেউ তো দূরের কথা, আমি নিজেই তো এখন বুঝতে পারছি না, ডান দিকের ঠিক কোন জায়গাটা দেবে গিয়ে রং উঠে লম্বা একটা ক্ষতচিহ্ন হয়েছিল এর গায়ে। দেখে মনে হচ্ছে ডেইন্টিং পেইন্টিং করা না, ডান দিকের সামনের আর পেছনের দুটো দরজাই বুঝি একদম নতুন লাগিয়ে দিয়েছে। ফলে রাস্তায় পুলিশি ঝামেলায় পড়ার আর কোন ঝুঁকি নাই ।

দ্বিতীয়ত, বস ফিল তার নেগোশিয়েশন স্কিলের সম্ভবত সর্বোচ্চটি খাঁটিয়ে গ্লোবাল অফিসকে বুঝিয়ে আমার বেতন ভাতাদি যে অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে, ওরকমটা তো দূরতম কল্পনাতেও ভাবিনি। এখন তো খুব সহজেই ঢাকায় গিয়ে নিজেদের জন্য একটা ফ্ল্যাট বুকিং দিতে পারবো। অতএব এবার দেশে গিয়ে, স্ত্রী ও বোনকে ব্যস্ত করে ফেলা যাবে ফ্ল্যাট বুকিং বিষয়ক ব্যাপারে। তবে সবচেয়ে ভাল যা ঘটেছে, তা হল তিন চার জন খুবই ভাল কাজের মানুষ চিনতে পেরেছি যাদেরকে গাইড করতে পারলে এখানে যে অতিরিক্ত দায়িত্ব জুটেছে কাঁধে সেগুলো হয়ে যাবে অনেকটাই সহজে। আমাদের লালন ফকির না যেন কোন এক বাউল সাধক বলেছিলেন : “ভবে মানুষ চেনা বড় দায়”। এ কথা অবশ্যই অতীব সত্য। অতএব এমন দাবী করছি না যে, এতো দ্রুত তাদের আমি পুরোপুরি চিনেছি। কিন্তু তারপরও মানুষ নিয়েতো অনেকদিনই কাজ করছি, তাই কোন মানুষটি বিরল প্রকৃতির কাজের মানুষ, তা না চিনলে তো কাজই হতো না সম্পাদন। এছাড়া এখানেও এ ব্যাপারে আমি যে সঠিক কাজের মানুষ চিনতে পেরেছি তার প্রমাণও তো মিলেছে এরই মধ্যে যেমন, সেই আসার পর থেকেই টিমের তরুণ তুর্কি তো না মিশরি আহমেদ নাশাতকে যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান, স্মার্ট আর আগ বাড়িয়ে কাজ করার লোক বলে মনে হয়েছিল, সেই প্রমানই তো দিল সে সেদিন হাতে হাতে! বিষয় হচ্ছে, ঐ যে নাশাতের ডায়াবেটিক ব্র্যান্ড মার্কেটে লঞ্চ করা, দুই মাস পিছিয়ে দেয়ার আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছুটা যে নটঘট বেঁধেছিল ফাংশনাল বস এরিকের সাথে, সেটি মেরামতের জন্য ফিল যে সমাধান বাতলে দিয়ে বলেছিল দুই মাসের জায়গায় এক মাস পেছাতে, আর এই এক মাসে যতোটা পারা যায় আগেকার প্ল্যানটির কিছু দুর্বলতা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঠিক করতে, সে বিষয়ে সেদিনই বিকেলে বসেছিলাম আহমেদ রাদির টিম নিয়ে, যেই টিমের সদস্য আহমেদ নাশাত গোটা ব্যাপারটি ব্রিফ করে, যখন রাদি ও নাশাতকে বলেছিলাম, দুই মাসের জায়গায় সময় পাবে তারা এখন, একমাস। তবে এই একমাসে তাদেরকে আগেকার প্লানের সব দুর্বলতা ঠিক করতে হবে না, বরং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারাই ঠিক করুক কোন কোন বিষয় ঠিক করবে, আর থাকবে বাকীগুলো ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস। উপরন্তু আমি তো আছিই সর্বক্ষণ তাদের সহযোগিতায়।

শুনে, রাদি যখন গভীরভাবে তার হাতে ধরা, আগে চিহ্নিত করা দুর্বলতা লিস্টিতে চোখ রেখে ভাবতে শুরু করেছে, তখনই নাশাত বলে উঠেছিল মিশরি টোনের ইংরেজিতে -“ইফ ড. রাদি এন্ড ইউ গাইড মি, আই ওয়ান্ট টু টেক ইট এজ এ চ্যালেঞ্জ এন্ড কারেক্ট অল ইন ওয়ান মান্থ। ইটস প্রেস্টিজ অব আওয়ার সাউদি টিম।”

নাশাতের ঐ সঙ্কল্প শুনে সাথে সাথেই উঠে তাকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে হলেও, সামলেছিলাম নিজেকে। কারণ বুজতে চাইছিলাম এ নিয়ে তার ডাইরেক্ট বস, রাদির প্রতিক্রিয়া। এরই মধ্যে বুঝেছি যতটুকু রাদিকে, তাতে সরাসরি নাশাতকে যদি বাহবা দেই, তবে নাশাতকে রাদি ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাবার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করবে নির্ঘাত। ফলে নাশাতকে তার কনফিডেন্সের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে, জানতে চাইলাম রাদির অভিমত

নাহ, গভীর জলের মাছ আহমেদ রাদীও দেখলাম ব্যাপারটি তার হলো কি হলো না তা বুঝতে না দিয়ে মুচকি হেসে প্রথমে আমার চোখে চোখ রেখে তারপর নাশাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “গুড নাশাত! আই নো ইউ কেন ডু ইট।”

দ্বিতীয় যেই ওয়ান ইন এ মিলিয়ন না হলেও অবশ্যই ওয়ান ইন এ থাউজেন্ট জেমটির দেখা পেয়েছি প্রথমবারের মতো দিন দুয়েক আগে, সেও আরেক মিশরি। নাম মোহাম্মেদ আল গার। খলিল মানে হেড অব সেলসের টিমের, কর্পোরেট ভাষায় যাকে বলা হয় ফার্স্ট লাইন ম্যানেজার, সে হল তা। আগে বেশ ক’বারই অফিসের করিডোরে তার সাথে দেখা হলেও, সালাম আদান প্রদানের বাইরে তেমন কথা হয়নি তার সাথে। তবে তার পজিটিভ দেহভঙ্গী, স্মিতহাসিতে ভরামুখ আর চলনে বলনে আছে যে এনার্জির ঝলক, চোখে পড়েছিল তার ওসবই। এই দিন দুই আগে বসেছিলাম যখন আমার সিনিয়র প্রডাক্ট ম্যানেজার পাকিস্তানী ডঃ আমির শামিমের সাথে, আসন্ন দুবাই মিটিংয়ের জন্য তার প্রস্তুতি রিভিউ করতে, সে সময়ে উপস্থিত মোহাম্মেদ গার কে পুরোপুরি না হলেও বেশ ভালই ধারণা করতে পেরেছিলাম তার সক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে তার সবচেয়ে বড় গুন যে পজিটভ এটিচুড, তা।

নিজ অফিস রুমের গোটা দেয়ালজুড়ে নানান ধরনের সার্টিফিকেট ঝুলিয়ে রেখে নিরবে নিজের মহিমা কীর্তনের ব্যবস্থা করে রাখা আমির শামিমকে প্রথমে আমি বেশ কাজের লোক মনে করে তার দিকে খুব একটা নজর দিচ্ছিলাম না এতদিন। কিন্তু দুবাই মিটিঙয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির রিভিউ মিটিং করতে দ্রুতই যখন সে নিজেকে মাকাল ফল হিসেবে তুলে ধরেছিল, নিজমনে ধাক্কা খেয়ে ভেবেছিলাম, আরে তো দেখি সাক্ষাৎ উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট। কি ভুলই না করেছি এতদিন। এ তো দেখছি ডোবাবে!

ঘটনা হচ্ছে বছরখানেক আগে আরেক বিশ্বখ্যাত কোম্পানি এস্ট্রা জেনেকা ছেড়ে আমাদের কোম্পানিতে যোগ দেয়া ডঃ শামিম দেখলাম কথা বলছে সবই থিউর‌্যাটিকাল। আরে বাবা থিউরি আমি অবশ্যই পছন্দ করি, কিন্তু কাজ যখন তোমার অপারেশনাল, সে জায়গায় শুধু থিউরি কপচালে তো হবে না। স্লাইডে তুমি কী লিখছ? বা কী রকম ডিজাইন করছো, তা দিয়ে তো কোন ফল প্রসব করবে না! কপাল ভাল যে, ধুরন্দর আমির নানান জনের সাথে করা আমার রিভিউ মিটিংয়ের খবর নিয়ে এরই মধ্যে সম্ভবত টের পেয়ে গিয়েছিল যে, আমাকে শুধু থিউরির ভুজং ভাজুং দিয়ে সামলানো যাবে না, যখন তার কাজের ধরন হল ধরি মাছ না ছুঁই পানি মার্কা। সে জন্য ঐ রিভিউ মিটিংয়ে মোহামেদ আল গারকে হাজির রেখেছিল সে। তো, মিটিংয়ের শুরুতে এই তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলেও, পরে যখন আমার নানান প্রশ্নের ঝটপট উত্তর দিতে শুরু করেছিল আল গার, বুঝলাম আরে এর উপরই তো ভর করে আছেন আমার আমীর, আমির শামিম! এতে একদিকে আমিরের উপর বিরক্তি এলেও খুশিও হয়েছি একিসাথে। কারণ নিজের দুর্বলতা, অলসতা ঢাকবার উসিলায় সে’ই তো আল গারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সেই থেকেই ঘুরছে আল গার মাথায়। ঠিক করেছি যে কোন সুযোগেই কাজে লাগাবো তাকে। এমন কি সুযোগ হলে নিয়ে নেব একদম আমার টিমেই।

বাহ, পজিটিভ থিংকিংয়ের পাওয়ার তো দেখছি বড়ই জবর! এরই মধ্যে তো দেখছি চলে এসেছি আমার কমপাউন্ডের কাছাকাছি। কিন্তু না, এখনি ঢুকবো না, কমপাউন্ডে। যাই বরং গ্রানাডা শপিংমলেই। ঠিক ১৪/১৫ দিন পরেই তো যাবো ঢাকায়। সে কারণে গত কয়েকদিন ধরেই, যখনই সুযোগ পাচ্ছি ঢুকছি শপিংমলে, বাসার জন্য বিশেষত আমার শিশু পুত্রদের জন্য নানান পনির, মেয়নেজ, বাটার, দুধ এসব কিনতে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণসাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাম্প্রতিক কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ও আমাদের প্রত্যাশা
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষাঙ্গনে ছাত্র সংসদের প্রয়োজনীয়তা