বাঁশের বাঁশি : ‘ও বাঁশি কেন গায় আমারে কাঁদায়’

ডা. দুলাল দাশ | শনিবার , ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

আজকের এই প্রবন্ধ রাখালিয়া বাঁশ নিয়ে, যেটা বাঁশের তৈরী এবং প্রেম, বিরহ ও আহ্বানের প্রতীক। বাঁশির সুর অনেক প্রাচীন; হাজার শত বৎসরের ইতিহাস ও রাখালিয়া বাঁশি, তুমি আমাকে কাঁদাও কেন, তোমার মন ভুলানো, প্রাণ ভুলানো সুর আমাকে বিচলিত করে, আমার ঘুম ভেঙ্গে দেয়, ধ্যান ভেঙ্গে যায়। এমন কী আছে ঐ বাঁশির সুরে। চৈত্রের দুপুরে, তেপান্তরের মাঠে রাখাল বাঁশি বাজাতে বাজাতে গরুর/ মহিষের পাল নিয়ে যাচ্ছে। সেই রাখালি বাঁশির সুর আমাদের ছোট বেলায়, যৌবনে দূর থেকে শুনতাম। কী মধুর সুর! আমরা আবেগে আপ্লুত হতাম। দিগন্ত জোড়া মাঠে ঝিম ধরা দুপুরে রাখালের বাঁশির যে সুর স্বর্গীয় অনুভূতি তৈরী করতো সেটা এখন কদচিত শুনা যায়। বাড়ির বারান্দায় বসে আছি। পুকুর পারে সান বাঁধানো ঘাটে বসে আছি বা বিকালে বটগাছ তলায় আড্ডা দিচ্ছি, এক পথিক বাঁশিতে সুর তোলে বাজাতে বাজাতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে এবং একটু গিয়ে রাস্তা থেকে নেমে বিলের মেঠো পথ ধরে পথের অপর প্রান্তে যাচ্ছে। সেই বাঁশির সুর আমরা আবেগ ভরে শুনতাম এবং কিছুক্ষণের জন্য অন্য জগতে হারিয়ে যেতাম, উদাস হয়ে যেতাম। গ্রামে, গঞ্জে শহরের মেলায় বাঁশি বিক্রি হয়। বাঁশিওয়ালা বিক্রেতা কি মধুর সুরে বাঁশি বাজিয়ে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের লোকদের আকৃষ্ট করে বাঁশি কেনার জন্য। যে ছোট ছেলেটা বাবার হাত ধরে মেলায় আসতো সে বায়না ধরতো ‘বাবা আমাকে একটা বাঁশি কিনে দাওনা। সেই ছেলেটা বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে। মেলায় রং বেরং এর বাঁশি উঠতো। এখনও বাঁশির কদর তেমন কমে যায়নি। তবে তার প্রকৃতি, গঠন অনেক উন্নতি হয়েছে। সংগীত পরিবেশনে বাঁশির ব্যবহার, অনস্বীকার্য। এর আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন আধুনিক গান থেকে শুরু করে ভাওয়াইয়া, লালনগীতি, রবীন্দ্র নজরুল সংগীত, পল্লী গীতি, পালাগাল, যাত্রাপালা, মুর্শিদি, গ্রামীণ পাল উৎসব সর্বত্রই এটা প্রযোজ্য। বাঁশের বাঁশিতে যাদু আছে, হেমেলিনের বংশীবাদকের কথা অনেকেই জানেন। রাজার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে সেই বংশবাদক বাঁশিতে এমন জাদুসুর তোল্লো হেমেলিনের সব শিশুরা তার কাছে জড়ো হলো এবং তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মত অনুসরণ করতে লাগল। এক পর্যায়ে সবায় বংশিবাদকের সাথে পাহাড়ের গুহায় অদৃশ্য হয়ে গেল। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে আছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে গোপাল হিসেবে গরু চারনোর সময় বাঁশি বাজিয়ে পোপীদের মোহিত করতেন। শ্রীকৃষ্ণ এমন সুরে বাঁশি বাজাতেন প্রেমিকা রাধাকে চুম্বকের মতো ঘর থেকে বের করে আনতেন। পল্লিকবি জসীম উদদীন লিখেছেনরাখাল ছেলে, রাখাল ছেলে, বারেক ফিরে চাও, বাকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও। খ্রিস্টধর্মের যিশুখৃষ্ট একজন পরিপূর্ণ রাখাল। প্রাচীন গ্রিক দেবতা ‘প্যান বাঁশি বাজাতেন। তিনি ছিলেন রাখাল ও পশু পালকদের দেবতা। আমাদের চট্টগ্রামের তথা বাংলাদেশের অন্যতম করা বংশিবাদক নাম তার বিনয় বাঁশি। উইলিয়াম শেকসপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ নাটক যেটা ষাটের দশকে রাখার বন্ধু নামে সিনেমা হয়েছিল সেখানে রাজ কন্যা রাখালকে বলেন, নিত্তি আসো নিত্তিরে যাও এই পথ দিয়া বনের ভ্রমর পাগল করো বাঁশি বাজাইয়া। তখন রাখাল বন্ধু পেয়ে উঠেন, আমি তো গরুর রাখার মাঠে থাকি, বাঁশরি বাজাইয়া পালের গরুবাছুর ডেকে আনি। প্রাচীনকালে নব্য প্রস্তর যুকে মানুষ খাবার জীবন ছেড়ে পশু পালন শুরু করে। তাদের রাখালদের সঙ্গী ছিল মূলত বাঁশি। প্রাচীন মেমোপটেমিয়া, আনাতোলিয়া, সিন্ধু সভ্যতা ও মিশরে রাখালির নিদর্শন পাওয়া যায় তারা পশু নিয়ন্ত্রণে বাঁশি ব্যবহার করতো। জার্মানির বাঁশি আবিষ্কার আরও প্রাচীন। গ্রীচে বাঁশির ব্যবহার শুরু হয় আড়াই হাজার বছর আগে। চীন, মিশর ভারত মধ্যপ্রাচ্যে বাঁশির ব্যবহার আরও প্রাচীন। ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, তুর্কি অঞ্চলে রাখালদের প্রিয় ছিল বাঁশের বাঁশি, বাঁশি, যোগাযোগ ও সংকেত দেওয়ার মাধ্যম ছিল। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চল রংপুর, ময়মনসিংহ, দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল প্রভৃতি জায়গায় রাখালি বাঁশির সুরে মেতে ওঠে। বড় বড় নদীর চরাঞ্চলের তৃণভূমিতে যেখানে গরু, মহিষ চরায় সেখান থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসে। এখন চারণভূমির স্বল্পতার কারণে রাখালি বাঁশির সুর অনেক কমে গেছে।

তবে দক্ষ বংশিবাদকরা বাঁশির ঝোলা কাঁদে শহরের রাস্তায় রাস্তায় মেঠো বাঁশির সুর তোলে কদাচিত পথচারীদের আকৃষ্ট করতে দেখা যায়। কাহিনীমতে, এক রাখাল যুবক তার প্রেমিকার কাছে পৌঁছানোর জন্য মাঠে বাঁশি বাজাতেন। আর প্রেমিকা তার বাঁশি শুনে প্রেমিকের অবস্থান বুঝতে পারতেন, বাঁশির সুর যতই মধুর হয় তত তার ভিন্নমাত্রা পায়। বাঁশের তৈরী রাখালি বাঁশি ও সুর শস্য শ্যামল গ্রাম বাংলার বিনোদনের মাধ্যম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, হয়ত আধুনিকতার বিভিন্ন ছোঁয়ায় ইহার জনপ্রিয়তা কমছে। তারপরও মন চায় গ্রামে একবার ঘুরে আসি। বাঁশির সুর যদি প্রকৃতির প্রাণ ও মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সেই বাঁশিতে থাকে স্বর্গীয় শক্তি ও প্রেম।

লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিও লজিস্ট,

বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদৈনিক আজাদী আমার প্রেরণা, আমার ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে