যুদ্ধবিরতির ফাঁকে

ফুয়াদ হাসান | শুক্রবার , ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

She says : When are you going to meet ?

I say : After a year and war

She says : When does the war end ?

I say : When we meet

-Mahmoud Darwish

তোমার সাথে আমার কখন দেখা হচ্ছে? যুদ্ধ শেষ হলে! যুদ্ধ কখন শেষ হবে? বছর শেষে, না আগামী বছর না আরও অনেক বছর পর! আদৌ কি যুদ্ধ শেষ হবে? আমরা তাহলে আর কখন দেখা করতে যাচ্ছি! নাকি আমাদের আর দেখাই হবে না কখনও। কারণ, যুদ্ধ তো আর কোনওদিনই শেষ হবে না।

যুদ্ধ কি আসলেই শেষ হয় কখনও। আমরা ছুটে যাই কেবল এক যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে আরেক যুদ্ধক্ষেত্রে। এক মৃত্যুপুরী থেকে অন্য কোন মৃত্যুপুরীতে। এ এক যাযাবর জীবনযাপন মানুষের, শুধু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পদার্পণ, ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে, সব হারিয়ে, সবকিছু ফেলে বাস্তুহীনদের এ কোন অভিযাত্রা। ছুটছে কেবল, একদল যুদ্ধের নেশায় অন্যদল যুদ্ধের ভয়াবহতায়। আমৃত্যু এই যুদ্ধযাত্রা মানুষের, আজন্ম এক কুরুক্ষেত্র এজীবন। একমাত্র বাঁচার আশায় আজীবন এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ছুটে বেড়াচ্ছে সর্বহারা মানবজাতি। আজ হয়তো এমন জীবনযাপন দেখতে পাচ্ছি গাজাবাসী, আরাকানীদের মাঝে। পেছনে এমন অবস্থা পেরিয়ে আসতে হয়েছে অন্য কোন জাতিকে, সামনে নিশ্চয়ই এমন সমস্যায় পড়বে অন্য কোন জনগোষ্ঠী। এ যেন এক অমোঘ নিয়তি। এটা তো কেবল আজকের সমস্যা নয়, সেই প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন নামে বা বর্ণে মানুষকে ভাগ করা হয়েছে বারবার এবং এমন করে নানাকালে বহুজনগোষ্ঠীকে এভাবে সর্বশান্ত হয়ে ছুটে বেড়াতে হয়েছে দিগ্‌িবদিক।

সুতরাং যুদ্ধ আদতে আর কখনই শেষ হবার নয়। যুদ্ধ কী করে থামবে,কীভাবে শেষ হবে। মানবজাতি চিরতরে নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার আগে এ যুদ্ধ থামবে না। মানুষের এ এক অব্যর্থ শপথ, নিজেদের পরিপূর্ণ শেষ না করলে তারা কোনভাবেই পিছপা হবে না, পিছু হটবে না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা গোত্রের নামে তারা নিজেদের ভেতর মারামারি করেই নিজেরা শেষ হয়ে যাবে, হয়তো আজ অথবা আগামীতে। যেমন, ‘আমাদেরও আগে বহুবার ধ্বংস হয়েছে পৃথিবী’।

আর শহীদ কাদরী, মাহমুদ দারবিশের মতো যুদ্ধবিরতির অপেক্ষা না করে এমন বলতে গেলেন কোন সাহসে!

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো

বি৫২ আর মিগ২১গুলো

মাথার ওপর গোঁগোঁ করবে

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো

চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো

প্যারাট্‌রুপারদের মতো ঝরে পড়বে

কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।’

প্রিয়তমাকে এমন মিথ্যে সান্ত্বনা দেয়ার কীবা মানে। কী প্রয়োজন ছিল এসব ভুলভাল বোঝানোর। যা কখনও হওয়ার নয় তা ভেবে কী লাভ। কী হবে, এসব প্রপঞ্চে পা দিয়ে, নিছক কল্পনার মায়ায় জড়িয়ে।

বব ডিলন গানে গানে যতই ছড়িয়ে দিক না কেন, balls fly/ before they’re forever banned? প্রকৃতপক্ষে সেই আনবিক বোমাগুলো যে কখনও নিষিদ্ধ হবে না সে তো আমাদের সকলেরই জানা। তারচেয়ে এই ভালো, প্রিয়তমার জন্যে পুরো পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে দেয়ার কথা দেয়া, সেটাই তো বহুগুণ বাস্তবসম্মত। কত ট্রয় ধ্বংস হয়ে গেছে, কত লঙ্কাকাণ্ড বেঁধেছে এক মানবীর জন্য।

যুদ্ধও তাহলে কী এক ধরনের রোমান্টিসিজম! যুদ্ধের খবর আমাদের দারুণভাবে উত্তেজিত করে, করে আন্দোলিত। যুদ্ধের প্রতীক্ষায় আমরা যেন বসে থাকি। ঘরে বা বাইরে কোথাও কোন যুদ্ধের খবর না পেলে ভীষণ পানসে কাটে জীবন, কিছুই ভালো লাগে না। যুদ্ধের খবরাখবর নাশুনলে যেন আমাদের পেটের ভাতই হজম হয় না, রাতে ঘুমও আসে না ঠিক মতো। টিভিতে বসে এযেন কোন শ্বাসরুদ্ধকর সিরিয়াল দেখা। যুদ্ধও তবে নেশা ধরায়, করে আন্দোলিত।

মঙ্গলগ্রহে জরিপ চলছে খুব,

সেখানে শুনছি ঘরবাড়ি তোলা হবে

জল্পনা ছোটে পশ্চিম থেকে পূব,

গ্রাম থেকে গ্রামে ডাক্তার যাবে কবে?

উপসাগরীয় যুদ্ধ টিভিতে দেখে,

খেয়েছে মানুষ রাতের খাবার রোজ

গণহত্যার ছবিগুলো মনে রেখে,

এসেছে শান্তি ঘুমের ওভার ডোজ।

আসল যুদ্ধ যেন সিরিয়াল দেখা,

অ্যাকশান খুব জীবন্ত খুনোখুনি

দেখছে মানুষ সপরিবারে বা একা,

ধর্ষণটাও দেখা যাবে এক্ষুনি।’

[জুয়া / কবীর সুমন]

এতো সব যুদ্ধের ভিড়ে আবার নতুন করে যে কোন একটা যুদ্ধ শুরু হলেই আমরা কোন না কোন পক্ষ নিয়ে ফেলি। যুদ্ধে সরাসরি না থেকেও প্রত্যেকে যেন যুদ্ধের ভেতরে থাকি। যুদ্ধের ভেতরই বসবাস করি।

১৯৪০ সালে হিটলারের হাতে ফ্রান্সের পতনের পর রবীন্দ্রনাথও আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান রুজভেলটকে চিঠির মাধ্যমে যুদ্ধে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তা হলে কী রবীন্দ্রনাথও সকলের মতো এমনটা মনে করেছিলেন, যুদ্ধ থেকে বের হতে হলেও যুদ্ধ প্রয়োজন। যুদ্ধ দিয়েই যুদ্ধকে থামাতে হয়! নাকি মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের এ এক সীমাবদ্ধতা, সে নিজের মতো করেই সবকিছুকে বিশ্লেষণ করে, আপন আবেগ ও যুক্তিতে, নিজস্ব সুবিধাজনক অবস্থার পরিমাপে।

যুদ্ধে কি কেউ কখনও জিতে! জয় পেয়েছিল কখনও কি কেউ! কে জয়ী হয়েছিল প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, সকলে বলবে জার্মানি হেরেছিলো। তবে জিতেছিল কে! মিত্রশক্তি? আসলে পুরো বিশ্বই হেরেছিল!

হিরোশিমানাগাসাকিতে পারমাণবিক হামলা করে আপাতদৃষ্টিতে অক্ষশক্তিকে চূড়ান্তরূপে পরাজিত করা গেলেও বস্তুত সেই মহাসমরে হেরেছিল সকলেই। লিটল বয় ও ফেট ম্যান আঘাতের তেজস্ক্রিয়তা জাপানের বুক থেকে কোন এক সময় মুছে যাবে হয়তো কিন্তু অ্যামেরিকার এই কলঙ্ক কি মানবজাতি ভুলবে কস্মিনকালেও! এই অপবাদ চিরকাল মাথা পেতে নিতে হবে মার্কিনিদের।

ওয়াটার লু’র যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হয়েছিলো;

জিতেছিলো কে?

সমস্ত পৃথিবী পরাজিতের নামটাই মনে রেখেছে।

আমিও

তোমার প্রেমে ব্যর্থ হয়েছিলাম।

তোমাকে কে চেনে!’

ময়ুখ চৌধুরীর এই কবিতার মতো পুরো পৃথিবীও আজ মনে রেখেছে পরাজিতকে। যদিও এই পরাজয়ের কলঙ্ক তার নয়। পারমাণবিক হামলার পরে আইনস্টাইনের অনুশোচনার মধ্যে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর যত গ্লানি। অন্যদিকে প্রায় বিশ বছর স্থায়ী ভিয়েতনামের যুদ্ধে অ্যামেরেকিরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেও ভিয়েতনামকেও কিন্তু জয়ী বলা যাবে না। মার্কিন আগ্রাসন পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগে লক্ষলক্ষ মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল দেশটা।

The war America lost, but Vietnam never won’- আসলেই তো, যুদ্ধে কখনই কেউ জিতে না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় হয়তো কেউ একজন জিতে গেছে কিন্তু যে ক্ষত ও ক্ষতির দাগ এঁকে যায়, সেখান থেকে কখনোই ঐ জনগোষ্ঠী পরিপূর্ণরূপে বের হয়ে আসতে পারে না। সেই রক্তের দাগ কখনও শুকায় না, মায়েদের অশ্রুনদী বয়ে বেড়ায় অনন্তকাল, শোক ও শবের চিহ্নগুলো বইতে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এমন কী দূরতম অন্য কোন এক শহরে বসেও সেই লেলিহান শিখার আঁচে দগ্ধ হয়, উপলব্ধি করে কেউ।

আমরা যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো

মিলি রাতের গভীর যামে,

তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা,

পড়ছে বোমা ভিয়েতনামে!’

নিছক একটি ‘প্রেমের কবিতা’র ভেতরেও শামসুর রাহমানকে আচ্ছন্ন করে রাখে কোন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরের বিষণ্নতা। দূরতম, অন্য কোন প্রেমিক যুগলের অসহায়ত্ব তাকে ক্লান্ত করে রাখে, যুগলপ্রেমকে ছাপিয়ে তাঁর এই মানবপ্রেম কবিতাটিকে নিয়ে যায় আলদা এক জায়গায়। কবিতা ও গানে নাহয় মানবতাবাদের গীত বাজানো হলো কিন্তু তাতে কি যুদ্ধ বন্ধ হয়! একজন কবি বা শিল্পী কি পারে যুদ্ধ বন্ধ করতে? ‘প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরওতো জানা।’

মানুষ প্রথম অস্ত্র আবিষ্কার করেছিল, বন্যপশুদের কাছ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে, খাদ্যের প্রয়োজনে শিকার করতে মাংসল প্রাণীদের অথচ সেই অস্ত্র এখন নিজেদের হত্যা করার জন্যই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই অস্ত্র আজ ঘুরে গেছে নিজেদের দিকে। মানুষ শিকারী এখন মানুষই চাঁদমারি।

পৃথিবীতে যে পরিমান মারণাস্ত্র রয়েছে তা দিয়ে কতকতবার ধ্বংস করা যাবে এই ভবলোক! বাকি সব সুদর্শন, চকচকে মারণাস্ত্রের কথা নাহয় বাদই দিলাম, কেবল যেসব পারমাণবিক বোমা রয়েছে মানুষের গোপন বাঙ্কারে তা দিয়ে কতবার হত্যা করা যাবে এই সখের পৃথিবী! শুধু কী পৃথিবী, না সে আঁচ গিয়ে লাগবে সৌরমন্ডলেও!

যে যুদ্ধ শুরু করে সে যুদ্ধ করে না, আর যে যুদ্ধ করে সে যুদ্ধ চায় নাপ্রবাদটাকে সত্য মনে করে সৈনিকদল ছুটে চলে তবু এক যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে অন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে, এক মিশন জয় করে নতুন কোনো টার্গেটে। সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশা পেয়ে বসলে তাকে আর থামানো যায় না। যুদ্ধের নেশা অনেক বড় নেশা। তখন সে আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন, চেঙ্গিস খানের মতো কেবল ছুটতেই থাকে। আর যত অখ্যাত, নাম না জানা, যুদ্ধে যেতে নাচাওয়া সৈনিকের রক্তে লাল হয় দায়া নদী, আর বেঁচে থাকা সৈন্যের ভাগ্য ঝুলে থাকে প্রিয়তমাসুকে লেখা সুকান্তের পঙ্‌ক্তিগুলো হয়ে

আমি যেন সেই বাতিওয়ালা

যে সন্ধ্যায় রাজপথেপথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে

অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য

নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।’

আমাদের আসলেই আর কোন পথ নেই, মাথার উপর বোমারু, পাশে ধস, গিরিখাদ, ঘর উড়ে গেছে, পড়ে আছে সন্তানের শব তবুও আমরা একে অপরকে আঁকড়ে ধরছি না, ক্রমশ ছেড়ে দিচ্ছি একে অন্যের হাত। যারা কজন এখনও বেঁচে আছি তাদেরকে তাই এভাবেই বেঁধে বেঁধে থাকার আকুতি জানিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ।

কিছুই কোথাও যদি নেই

তবু তো কজন আছি বাকি

আয় আরো হাতে হাত রেখে

আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।’

যুদ্ধের বিরুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের এই সম্মিলিত একত্রিত হয়ে থাকা, সামষ্টিক যাত্রাই পারে কেবল এই যুদ্ধ থেকে মুক্তি দিতে। সকলে যুদ্ধের বিরুদ্ধে হাতে হাত রেখে প্রতিবাদ করলে হয়তো পৃথিবী বেঁচে যাবে এবারের মতো। কিন্তু তাও তো এক কল্পনাপ্রসূত প্রলাপ মাত্র!

পূর্ববর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে রক্তদান উৎসব ও ওয়াজ মাহফিল কাল
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারী নাজিরহাট কলেজে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন