বিশাল ভারতবর্ষে সুলতানী আমল এবং মোঘল আমলের রাজা–বাদশাহগণের সমাধিসৌধ, সাথে নানান বিশাল বিশাল স্থাপত্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে চিন্তা করলে বাদশাহ শাহজাহান নির্মিত দিল্লীর জামে মসজিদ জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিন্তা করলে বাদশাহ শাহজাহান শায়িত রয়েছেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজের জন্য নির্মিত তাজমহলের ভিতর স্ত্রীরপাশে। তিনি চেয়েছিলেন যমুনা নদীর এই পাড়ে সাদা মর্মর পাথরে মমতাজের জন্য তাজমহল নির্মাণ করবেন, করেছেনও তাই। যা বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য্যের মধ্যে অন্যতম। যমুনার ঐপাড়ে কালো পাথরে তার নিজের জন্য আরেকটি সমাধিসৌধ নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ভ্রাতৃ কলহে যুদ্ধের কারণে পুত্র আওরঙ্গজেব কর্তৃক পিতা শাহজাহান আগ্রার দুর্গে নজরবন্দি হন। ঐ অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করলেন। বাদশাহ আওরঙ্গজেব কালো পাথরের সমাধিসৌধ নির্মাণ পরিকল্পনা বাদ দিয়ে পিতাকে মায়ের পাশে শায়িত করে দেন। যে কেউ তাজমহল দেখতে গেলে দেখা যাবে মমতাজের কবর ঠিক মাঝখানে তথা সেন্টারে। আর শাহজাহানের কবর স্ত্রীর একপাশে তথা পশ্চিমপাশে। দিল্লীতে জামে মসজিদ নির্মাণ করে থাকলেও আগ্রা তাজমহলের কাছে মসজিদ নামক ইমারতটি ম্লান। শাহজাহানের পিতা জাহাঙ্গীর। লাহোরে বিশাল সমাধিসৌধ নিয়ে শায়িত। তার কিছুটা দূরত্বে তার স্ত্রী নূরজাহান সাদামাটাভাবে শায়িত।
জাহাঙ্গীরের পিতা আকবর প্রায় এক বা আধা বর্গ কি.মি এরিয়া বিশাল সমাধিসৌধ নিয়ে আগ্রার জমিনে শায়িত। তার পিতা হুমায়ুন। দিল্লী নেজামুদ্দীন এরিয়ায় আধা বর্গ কি.মি বা কম বেশি ইমারতে এরিয়া নিয়ে শায়িত। তার পিতা বাবর আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে শায়িত।
শাহজাহানের পুত্র আওরঙ্গজেব দক্ষিণ ভারতে মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গবাদে এক পাহাড়ের উপর শায়িত। তিনি ইন্তেকাল করেন আহমদ নগরে। হযরত খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার অন্যতম খলিফা হচ্ছেন খাজা বোরহান উদ্দিন (রহ.)। তারই খলিফা হচ্ছেন হযরত খাজা জৈন উদ্দিন (রহ.)। উভয় খাজার কবর ২/৩ শত মিটারের ব্যবধানে। আওরঙ্গজেবের অছিয়ত মতে তার মরদেহ আহমদ নগর থেকে এখানে এনে শায়িত করা হয়। হায়দ্রাবাদের নিজাম কবরের উপরি ভাগ মাটি রেখে চতুর্দিকে অত্যধিক দামী সাদা পাথর দিয়ে মুড়িয়ে দেয়। যদিওবা আমি এখানে গিয়ে সালাম দিয়ে যেয়ারত করি। বাকী তার চার অগ্রজ তথা শাহজাহান, জাহাঙ্গীর, আকবর, হুমায়ুনের বিশাল বিশাল সমাধিসৌধে ন্যূনতম যেয়ারতের পরিবেশ দেখলাম না।
আওরঙ্গজেবের পুত্র আজম শাহ তার মাতা সম্রাজ্ঞী রাবেয়া উদ দুরানী ইন্তেকাল করলে ঔরঙ্গবাদ শহরে তাকে শায়িত করেন। মুহাম্মদ আজম শাহ দাদী মমতাজ মহলের সমাধিসৌধ তথা তাজমহলের আদলে ঔরঙ্গবাদে ২য় আরেকটি তাজমহল নির্মাণের দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করে দেন। যদিওবা এই সমাধিসৌধ তাজমহলের সাথে তুলনায় আসবে না। এখানেও আমার যাওয়া হয়েছিল দেখার জন্য।
হায়দ্রাবাদের বিশ্বখ্যাত গোলকুন্ডা দুর্গ। বাদশাহ আওরঙ্গজেব কুতুব শাহীদের নিকট থেকে এই দুর্গ জয় করতে যেমন দীর্ঘ সময় নেয়, তেমনি উভয় পক্ষে হাজার হাজার লোকের প্রাণ যায়। এই দুর্গ থেকে কিছুটা দূরত্বে কুতুব শাহীদের সমাধিসৌধ প্রায় ১ বর্গ কি.মি বা কম বেশি এরিয়া নিয়ে। এখানে ৮/১০ টি বিশাল বিশাল সমাধিসৌধ রয়েছে। তৎমধ্যে কুতুব শাহী সুলতানের স্ত্রী হায়াত বক্সী বেগমের বিশাল সমাধিসৌধ দেখলে ভাবিয়ে তুলবে। এখানেও আমার ঘুরতে যাওয়া হয়েছিল। দেখলাম না কাউকে সূরা ফাতেহা পড়ে দোয়া করতে, সবাই ঘুরতে দৃশ্য উপভোগ করতে এখানে আসে।
বিজাপুরের গোল গম্বুজটি বিশ্বখ্যাত। গোল গম্বুজ আদিল শাহী রাজবংশের নির্মিত সবচেয়ে উচ্চাকাক্ষী স্থাপনাগুলোর মধ্যে একটি। শুধু তাই নয়, বিশ্বের বৃহত্তম একক কক্ষের স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। যার চওড়া প্রায় ৪১ মিটার, উচ্চতা ৬০ মিটার। এখানে শায়িত আছেন আদিল শাহ, তার দুই স্ত্রী, উপপত্নি, ভগ্নি, মেয়ে, নাতি।
ইহা নাকি বিশ্বের ২য় বৃহত্তম গম্বুজ। আরও রয়েছে নিজাম শাহীর ছোট বড় স্থাপত্য। দিল্লীতে রয়েছে লোদি গার্ডেন। এখানেও লোদিগণের বিশাল বিশাল সমাধিসৌধ রয়েছে। পুরাতন দিল্লীতে কুতুব মিনার বাদেও সুলতানী আমলের সমাধিসৌধ নানান স্থাপত্যের ভংগ্নাংশ দৃষ্টিগোচর হবে।
দিল্লীতে লালবাগ কেল্লা, পুরাতন কেল্লা, আগ্রা কেল্লা, জৈনপুর, লক্ষ্মৌ তথা বিশাল ভারতের এমন কোন শহর পাওয়া যাবে না যে, শহরে সুলতানী আমল বা মোঘল আমলের কম বেশি স্থাপনা নেই। দিল্লী জামে মসজিদ লাহোরে বাদশাহী মসজিদের মত কিছু ধর্মীয় স্থাপনা বাদে বাকী সব তাদের সমাধিসৌধ বা প্রাসাদ এসব নিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে টিকেট কেটে এখানে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু টিকেট কেটে সাধারণ জনগণ প্রবেশ করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখছে কিনা! ২ শত বছর থেকে ৪/৫ শত বছর আগে নির্মিত এসব সমাধিসৌধ ও প্রাসাদসমূহ দেখে সুলতানী–মোঘলদের প্রতি মানুষ শ্রদ্ধা রাখছে নাকি ঘৃণা রাখছে। এমনিতে তাদের মদ, নারী নিয়ে বিলাসি জীবনের কথা বর্তমানকালেও ইতিহাস জানান দিয়ে যাচ্ছে। আফগান পারস্যের ওখান থেকে এসে ভারতবর্ষ দখল করে। অস্ত্রের বলে বলীয়ান হয়ে তারা প্রায় ৩/৪ শত বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। যদি বাদশাহ শাহজাহান দিল্লী জামে মসজিদের চত্বরে বা পাশে তার প্রিয়তমা মমতাজের কবরটা দিত কতই না উত্তম হত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তিনি তা করলেন না। বাদশাহ শাহজাহানও তো অসিয়ত করে যেতে পারতেন দিল্লী জামে মসজিদ চত্বরের একপাশে তার কবর দেয়ার জন্য। কিন্তু তা তিনি করেননি।
এই ভুল করেননি তুরস্কের সুলতানগণ। সুলতানী আমল, মোঘল আমল ছিল ভারতবর্ষ কেন্দ্রীক। দামেস্ক কেন্দ্রীক ওমাইয়া শাসন; বাগদাদ কেন্দ্রীয় আব্বাসীয় শাসন; কায়রো কেন্দ্রীক ফাতেমী শাসন; মুসলিম জাহানের হয়ত একটি বড় অংশ তারা নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু তুর্কি সুলতানেরা বিশ্ব শাসন করে গেছেন প্রায় ৪/৫ শত বছর। তুর্কি সুলতানগণের ভয়ে ইউরোপ, ব্রিটেনসহ ফ্রান্স তটস্থ থাকত। ইস্তাম্বুল কেন্দ্রিক তাদের সমাধিসৌধ নিয়ে আগামীবারে লিখব আশা রাখি।
সুলতানী আমল এবং মোঘল আমলে ভারতের গরীব জনগণের করের টাকায় এইসব বিলাসি স্থাপনা সাধারণ জনগণের মাঝে ঘৃণাবাদে সম্মান আবেগে তাড়িত হবেন বলে মনে করি না। অথচ সেই যুগে লাখ লাখ মানুষ ছিল দরিদ্র পিড়িত চিকিৎসাহীন শিক্ষাহীন। সেই সময়ের কথা বাদও দিলাম বর্তমানকালেও প্রায় সময় দেখা যায় উপমহাদেশের ধনকুবেরদের মধ্যে ২/১ জন বাদে অধিকাংশের অর্থ ব্যয় হয় ব্যক্তিগত বিলাসিতায় বিয়ের নামে কোটি কোটি টাকা অপচয়, নায়ক–নায়িকা এনে নাচানো তাদের নোংরা পেশনে পরিণত হয়েছে যা সাধারণ জনগণ ঘৃণার চোখে দেখে।
বিশাল ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন শহরে যাওয়ার সুযোগ হয়। কেন জানি মুসলমান নামধারী রাজা বাদশাহ গরীব থেকে করের নামে টাকা শোষণ করে মদ, নারী বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়। যার দুর্নাম ঘৃণা ইতিহাসের পাতায় পাতায়। তারা বয়স বাড়লে নিজের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সমাধিসৌধ নির্মাণ করে। যা তাদের দূরদর্শিতার অভাব।
হায়দ্রাবাদ নিজামদের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশের সাথে অতীব সুসম্পর্ক থাকায় তাদের স্বায়ত্ত শাসনের মর্যাদা দেয়। তাদের নির্মিত ভোগ বিলাসের প্রাসাদ প্যালেস একালে দর্শকদের ভাবিয়ে তুলবে স্বাভাবিক। তাদের প্রাসাদ কমপ্লেক্সকে চৌমহল্লা প্যালেস বলা হয়। যদিওবা ২০০২ সালে হায়দ্রাবাদ সফরকালে এই চৌমহল্লা প্যালেস দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। ভারতবর্ষের মোঘল সুলতানী আমলে বিলাসিতা জনগণের করের টাকা অপচয় করে শত শত বছর পরও আজ অবধি জনগণের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে রয়েছে।
আমাদের দেশের নব্য ধনীরা যারা শত হাজার কোটি টাকার মালিক তাদের জীবনপ্রবাহ, তাদের অর্থ বাড়ী দামি গাড়ি এই সবের কারণে জনগণের নিকট যাতে ঘৃণার পাত্র না হয়।
ভারতবর্ষের রাজা–বাদশাহ তাদের বেগমদের সমাধিসৌধের অধিকাংশ ক্ষেত্রে টিকেট কেটে প্রবেশ করতে হয় বিনোদনের জন্য ঘুরবার জন্য। তারা মুসলমান হলেও মনে হয় না সৌভাগ্যবান, জনগণ তাদের সালাম দিয়ে সূরা ফাতেহা পড়ে। বরং মনে হয় গরীব জনগণের করের টাকায় নিজেদের, বেগমদের সমাধিসৌধ নামক বিলাসিতা অপব্যয়ের জন্য মন থেকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে স্বাভাবিক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।











