‘ভুয়া তথ্য’ দিয়ে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে প্রায় ২১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ‘আত্মসাতের’ অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের সঙ্গে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে মোট ২৫ জনকে। তাদের মধ্যে ইউসিবির সাবেক ১৩ জন পরিচালকসহ ঋণ দেওয়ার সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও রয়েছেন। খবর বিডিনিউজের।
দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে এ মামলা দায়ের করেন সংস্থার উপ–সহকারী পরিচালক মো. রুবেল হোসেন। সংস্থার উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার এ মামলা হওয়ার কথা বলেছেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সময়কালে ব্যাংকটির পর্ষদ জাবেদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। শেখ হাসিনার সরকারে মন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি নিজেও ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ১২০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে জাবেদ ও তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
চট্টগ্রামের কোতয়ালী থানায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে করা ওই মামলায় পাচার করা অর্থ দিয়ে দুবাইয়ে ২২৬টি ফ্ল্যাট কেনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ ও পরিচালনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার অভিযোগ আনে পুলিশের বিশেষায়িত এ ইউনিট।
নতুন মামলার অন্য আসামিরা হলেন– মডেল ট্রেডিং ও আরামিট পিএলসির জুনিয়র অফিসার মোহাম্মদ মিছাবাহুল আলম এবং মডেল ট্রেডিং এর হিসাব খোলার পরিচয়দানকারী মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ। এছাড়া ইউসিবির সাবেক সিনিয়র এঙিকিউটিভ অফিসার শ্রাবন্তী মজুমদার, সাবেক এফএভিপি ও ম্যানেজার অপারেশন মোসাদ্দেক মো. ইউসুফ, সাবেক এঙিকিউটিভ মুঝায়োনা সিদ্দিকা, সাবেক এভিপি ও ক্রেডিট অফিসার মোহাম্মদ গোলাম রাকিব, সাবেক এফভিপি ও শাখা প্রধান তালমগীর কবির, স্বত্বাধিকারী ও এজিএম মো. আব্দুল আজিজ, এঙিকিউটিভ (একাউন্টস) মো. ইউসুফ চৌধুরী, সাবেক পরিচালক ইউনুছ আহমদ, সাবেক পরিচালক আনিসুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক পরিচালক আখতার মতিন চৌধুরী, সাবেক পরিচালক এম এ সবুর, সাবেক পরিচালক হাজী আবু কালাম, সাবেক পরিচালক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বজল আহমেদ বাবুল, সাবেক পরিচালক আসিফুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক পরিচালক রোকসানা জামান চৌধুরী, সাবেক পরিচালক বশির আহমেদ, সাবেক পরিচালক আফরোজা জামান, সাবেক পরিচালক সৈয়দ কামরুজ্জামান, সাবেক পরিচালক মো. শাহ আলম ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ কাদরীকে আসামি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার দুদকের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, জাবেদ তার মালিকানাধীন আরামিট গ্রুপের এক কর্মচারীর নামে ‘মডেল ট্রেডিং’ নামের একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এরপর ভুয়া তথ্য জমা দিয়ে ইউসিবি থেকে প্রায় ২১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেননি।
এজাহারে অভিযোগ করা হয়, ঋণের অর্থ বিভিন্নভাবে বিতরণ, হস্তান্তর, স্থানান্তর এবং নগদ উত্তোলনের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়। জাবেদের ব্যাংক হিসাব এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট দায়–দেনা পরিশোধেও ওই অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বলা হয়, এ ঋণের মেয়াদ শেষ হলে অনিয়ম ঢাকতে ইউসিবিএলের অন্য গ্রাহকের নামে নতুন ঋণ অনুমোদন করা হয় এবং সেই অর্থ দিয়ে আগের ঋণ সমন্বয় দেখানোর চেষ্টা করা হয়। মামলায় দুদক বলেছে, আসামিরা যোগসাজশের মাধ্যমে ‘প্রতারণা ও জালিয়াতি করে ক্ষমতার অপব্যবহার’ করেছেন, যা মানি লন্ডারিং অপরাধের শামিল। মামলার তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের ১৪ জানুয়ারি আরামিট পিএলসির জুনিয়র অফিসার মোহাম্মদ মিছাবাহুল আলম ‘মডেল ট্রেডিং’ এর স্বত্বাধিকারী হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেন। পরে ৮ জুলাই তিনি ইউসিবির কারওয়ান বাজার শাখায় একটি চলতি হিসাব খোলেন। ব্যাংকের কর্মকর্তারা কোনো যাচাই–বাছাই না করেই ওই অ্যাকাউন্ট চালু করেন। পরদিন ৩০ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদি ঋণের জন্য আবেদন করা হয়।
এজাহারে অভিযোগ করা হয়, শাখার কর্মকর্তা ও ঋণ পরিদর্শকরা ব্যবসার মালিকানা, অফিসের ঠিকানা, গুদামের আয়তন এবং পণ্যের মজুদের পরিমাণ সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেন। ঋণ প্রস্তাবটি ব্যাংকের করপোরেট অফিসে পাঠানো হলে প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটির নেতিবাচক মতামত থাকার পরও ২৫ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর অর্থ যথাযথ খাতে ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা যাচাই না করেই নগদ উত্তোলন ও স্থানান্তরের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা হয়। ঋণের মেয়াদ শেষে আরেকটি ঋণ ব্যবহার করে আগের দায় সমন্বয় দেখানোর চেষ্টা হয়। ছাত্র–জনতার তুমুল আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর ওই সময়কার সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও শিল্পগোষ্ঠীর অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক। এর ধারাবাহিকতায় সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাবেদ ও তার আরামিট গ্রুপের অর্থপাচারের বিষয়েও অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি। জাবেদ এবং তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুদকের উপপরিচালক মশিউর রহমানকে। এ অনুসন্ধান দলে ৯ জন সদস্য রয়েছেন।












