সপ্তাহব্যাপী তীব্র বিমান হামলার পর গাজা সিটিতে স্থল অভিযানের মূল পর্যায় শুরু করেছে ইসরায়েলি সেনারা। রাতভর ভারি বোমা হামলা হওয়ার কথা জানিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা। গতকাল মঙ্গলবার এই অভিযানের ঘোষণা দিয়ে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কার্টজ এঙে এক পোস্টে লিখেছেন ‘গাজা জ্বলছে।’ নগরীর ওপর আকাশ, সমুদ্র ও স্থল তিন দিক দিয়ে আক্রমণ চলছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বিকট বিস্ফোরণ দেখার কথা জানিয়েছেন। বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। তারা মঙ্গলবারের বোমা হামলাকে গাজায় দুইবছরের যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক বলে বর্ণনা করেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এর কর্মকর্তারা বলেছেন, স্থলসেনারা গাজা সিটির অনেক ভেতরে প্রবেশ করছে। কেন্দ্রস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তারা। আগামী দিনগুলোতে সেনা সংখ্যা আরও বাড়বে। গাজা সিটিতে ৩ হাজার হামাস যোদ্ধা রয়েছে বলে বিশ্বাস আইডিএফ এর। তাদেরকে মোকাবেলায় এই বাড়তি সেনা নামানো হবে বলে জানিয়েছে আইডিএফ। খবর বিডিনিউজের।
গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা গতকাল সকালের দিকে ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৪০ জন নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছেন। এর নিহতদের বেশিরভাগই গাজা সিটির। সেখানে ইসরায়েলের বিমান হামলা চলার পাশাপাশি কয়েকটি স্থানে ইসরায়েলি ট্যাংক ঢুকে পড়ার খবর জানিয়েছে বাসিন্দারা। তাদের অনেকেই পালিয়ে যাচ্ছেন, যদিও তাদের নিরাপদে যাওয়ার মতো কোনও জায়গা নেই। গাজার সবচেয়ে বড় এই শহরে এখনো কয়েক লাখ বাসিন্দা অবস্থান করছেন, যেখানে ইতোমধ্যে ইসরায়েলি অবরোধের কারণে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন যে অভিযানটি এখন প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, গাজা সিটি হামাসের শেষ কয়েকটি শক্ত ঘাঁটির একটি। ইসরায়েল নতুন করে গাজা সিটির বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ফিলিস্তিনিরা দক্ষিণ এবং পশ্চিমের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের এক সামরিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী গোষ্ঠী হামাসকে পরাজিত করতে যতদিন প্রয়োজন ততদিন সেনারা গাজা সিটিতে অভিযান চালাবে। তিনি আরও বলেন, সেনারা অভিযান দ্রুত শেষ করতে চায় এবং জিম্মি ও বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
গণহত্যা চালিয়েছে ইসরায়েল : এদিকে জাতিসংঘের একটি তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল গণহত্যা চালিয়েছে। ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজায় প্রায় দুই বছর ধরে যুদ্ধ চলার পর এটিকে একটি ‘বৈশিষ্ট্য সূচক মুহূর্ত’ বলে বর্ণনা করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। বিবিসি জানিয়েছে, একটি নতুন প্রতিবেদনে জাতিসংঘ তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, ২০২৩ সালে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সংজ্ঞায়িত পাঁচটি গণহত্যার মধ্যে চারটি সংঘটিত হয়েছে বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলে তদন্তের জন্য জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক কমিশনের চেয়ারপারসন নাভি পিল্লাই মঙ্গলবার জাতিসংঘের তদন্তের এই ঘোষণাটি দিয়েছেন বলে আল জাজিরা জানিয়েছে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে ইসরায়েলি নেতাদের উদ্ধৃতি, ইসরায়েলি বাহিনীর আচরণের ধরন গণহত্যার অভিপ্রায়ের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কমিশন দেখেছে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দেওয়া বিবৃতির পাশাপাশি ‘পরিস্থিতিগত প্রমাণ’ও আছে যেগুলো গণহত্যা অভিপ্রায় খুঁজে পাওয়ার দিকে নিয়ে গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশন সিদ্ধান্তে এসেছে যে ইসরায়েলের কর্তৃপক্ষ ও ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর গাজা ভূখণ্ডের ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবে ধ্বংস করার গণহত্যার অভিপ্রায় আছে।
তবে জাতিসংঘের জেনিভা দপ্তরে নিয়োজিত ইসরায়েলি স্থায়ী প্রতিনিধি ড্যানিয়েল মেরন তদন্ত প্রতিবেদনটিতে যেসব তথ্য উঠে এসেছে সেগুলো প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবেদনটিতে ‘কলঙ্কজনক’, ‘মিথ্যা’ ও একটি ‘মানহানিকর কটুক্তি’ বলে উল্লেখ করেছেন।
অভিযান বন্ধের আহ্বান : জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক ইসরায়েলকে অবিলম্বে গাজা সিটিতে গতকাল মঙ্গলবার শুরু হওয়া স্থল অভিযান বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং আরও অনেক অপরাধের প্রমাণ বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জেনিভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ভলকার তুর্ক সাংবাদিকদের বলেছেন, আমি কেবল তাদের কথা চিন্তা করছি যারা নারী, অপুষ্টিতে ভোগা শিশু, চলাফেরায় অক্ষম মানুষ তাদের কথা। তারা যদি আবার এভাবে আক্রমণের শিকার হয় তাহলে তা কী দাঁড়াবে? তাই আমাকে বলতেই হচ্ছে যে, এর প্রতিক্রিয়ায় একটা কথাই বলা যায়, তা হচ্ছে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করুন। আমি অকারণে গাজা ধ্বংস বন্ধ করার জন্য ইসরায়েলকে আহ্বান জানাচ্ছি।












