আঁরার দুরুস কুরা

আফরোজা এনাম | মঙ্গলবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বচন ছোটবেলায় দাদুর মুখে শুনতাম

জামাই আইলে ডেইঙ্গা রাতা

বিয়াই আইলে রসের কথা।’

আবহমান কাল থেকে সংস্কৃতি মানুষের রক্তের সাথে মিশে রয়েছে। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা চলছে। সংস্কৃতির অন্যতম অংশ খাদ্য। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে আমরা খাদ্য খাই। এর মধ্য অনেকগুলো খাদ্য আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ‘দুরুস কুরা’ এক প্রকার ভোজনবিলাসী খাদ্য ‘কুরা’। কুরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দ। আভিধানিক অর্থ মুরগ/মুরগী। দুরুস কুরা মানে আস্ত মোরগ বা মুরগি একে মোসাম্মন, মোসাল্লম বলে।

আমাদের চাটগাঁইয়ারা আস্ত মুরগি/কুরা জবাই করে চামড়া ছিলে নাড়িভুঁড়ি বের করে। শৈল্পিকভাবে মুরগির গলাপা মুচড়িয়ে পেটের ভিতর ঢুকিয়ে নাম দিয়েছে দুরুস কুরা। দুরুস কুরা মানে বিয়ে বাড়িতে নতুন জামাই বা বেয়াই বেয়াইনের টেবিলে না থাকলে তুমুল ঝগড়া লাগে। চট্টগ্রামের ভোজনরসদ দুরুস কুরার ডিশ নতুন বেয়াইবেয়াইনের বা জামাইয়ের খাবারের টেবিলে থাকা চায়। দুরুস শব্দটি এখন আমাদের এটি চট্টগ্রামের নিজস্ব লোকজ সংস্কৃতির অংশও বটে।

এর ইতিহাস অনেকটা পুরানো। বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রামে আদিকাল থেকে পরিভ্রাজক, সুফিসাধক, মোগল আরকানি, পর্তুগিজ, ইংরেজ, আরবী, ব্রিটিশ জাতির আগমনের কারণে অন্য জেলার থেকে চট্টগ্রামের মানুষ অধিক ভোজনরসিক এবং আপ্যায়নপ্রিয়। এই দুরুস কুরার প্রচলন আরকান আমল থেকে। বিশেষ করে বিয়েতে খাদ্যসম্ভারে এর জনপ্রিয়তা শীর্ষে। এর বিচ্যুতি বিরুপ প্রতিক্রিয়া।

দুরুস কুরার প্রচলন আরাকানি আমল থেকে। আরাকানের রোহিঙ্গারা এই দুরুস কুরা বা আস্ত মুরগি দিয়ে গরবাদের (মেহমান) সমাদার (আপ্যায়ন) করে থাকে। দুরুস কুরা মিশরীয়দেরও খুব প্রিয় খাবার। মিশরেও দুরুস কুরার প্রচলন আছে।

চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরী দুরুস পোলাও নিয়ে লিখেছেন ‘জবাই করা আস্ত মুরগি, মরিচ ও মসলা সহযোগে সিদ্ধ করার পর আগুনে সেঁকে নিয়ে সরষে তেলে ভেজে নিলে দুরুস প্রস্তুত হয়। সরিষার তেল বা ঘি মসলা পিঁয়াজ সহযোগে রান্না করা ভাত হলো পোলাও। এই শতকের তৃতীয় দশকের পর থেকে লোকের রুচি পরিবর্তনের ফলে দুরুস পোলাও এর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়।’ ইবনে বতুতার (১৩০৪১৩৬৮ খ্রি.) ভ্রমণ কাহিনিতে উল্লেখ আছে, সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ (১৩২৫১৩৫২ খ্রি.) বিন তুঘলকের প্রিয় খাবার ছিলো দুরুস কুরা। তবে নতুন জামাই এবং বিয়ে বাড়িতে বেয়াই বেয়াইন কিংবা সম্মানি মানুষের খাবার টেবিলে দুরুস পরিবেশন হবে না এটা অসম্ভব। দুরুস কুরা যখন টেবিলে আসে বেয়াই বেয়াইন বা নতুন জামানই সবাই মিলে এক সাথে ধরে এটি ভাঙতে হয়। সবার প্লেটে এক টুকরো করে পরিবেশনে খাবারের আনন্দটাও বেড়ে যায়। দুরুস কুরা ছাড়া খাবারের মেনু পূর্ণ হয় না।

দুরুস কুরার উপকরণ : আস্ত মুরগি একটি, পেঁয়াজ বাটা চার কাপ, জিরা বাটা এক চা চামচ, আদা বাটা তিন চা চামচ, গরম মসলা এক চা চামচ, জর্দার রং সিকি চা চামচ, হলুদ আধা চা চামচ, পোস্তবাটা এক চা চামচ, কাজুবাদাম বাটা এক টেবিল চামচ, লবণ ও তেল পরিমাণমতো, নারকেল বাটা সিকি এক কাপ, কিশমিশ পনেরো থেকে বিশটি, বেরেস্তার পিঁয়াজ এক কাপ, জায়ফল ৪টি, টক দই পাঁচ থেকে ছয় চামচ নিয়ে পেস্ট করে, কেউড়া জল এক টেবিল চামচ, দুধ এক কাপ, চিনি ১ চা চামচ, কিশমিশ ১০টি, কেওড়া জল ১ টেবিল চা চামচ। চামচ দিয়ে মেরিনেট করে চামড়া ছিলা আস্ত মুরগিটি দিয়ে দিন।

দুরুস কুরা রন্ধন প্রণালি : মুরগিটি জবাই করে চামড়া ছড়ানো হয়। মুরগির পাঁজরের দুই পাশে ছিদ্র করে রান দুটো ও গলা খাদ্যনালি বরাবর ঢুকিয়ে দিতে হবে। দুরুস কুরা তৈরি করাও একটি শৈল্পিক কাজ। আস্ত মুরগিটি কাঁটা চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে ছিদ্র করুন। রান্নার প্রণালীতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন মসলা মাখিয়ে আস্ত মুরগি তেলে ভেজে এরপর মসলায় কষিয়ে ভুনা করে রান্না করা হয়। যাকে বলা হয় আস্ত মুরগির রোস্ট বা দুরুস কুরা। এভাবে তৈরি হয় দুরুস কুরা তথা মোসাম্মান। চট্টগ্রামের খাদ্য তালিকায় সংস্কৃতির অংশ হয়ে গিয়েছে। খাদ্যাভাস আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। তাই আমাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। খাদ্যগুলো বেশি বেশি প্রচলন রাখতে হলে, খাদ্যগুলো বেশি বেশি প্রচলন রাখতে হবে। কেননা খনার বচনে পড়েছি ‘মাংসে মাংস বৃদ্ধি, ঘৃতে বৃদ্ধি বল’

তথ্য ঋণ : লেখক রশীদ এনামের ‘রসনা জৌলুসে অনন্য চাটগাঁ’।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সহকারী শিক্ষক, পশ্চিম পটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাহাড়ের জীবন ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি
পরবর্তী নিবন্ধসিজেকেএস বেসবল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প সম্পন্ন