চট্টগ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বেলা বিস্কুট এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। এটি শুধু একটি খাবার নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক চিহ্ন। চট্টগ্রামের বিকেলের চায়ের সঙ্গে, বিশেষ করে শীতকালে, বেলা বিস্কুট ডুবিয়ে খাওয়ার প্রচলন বহু পুরনো। এটি সাধারণ বিস্কুটের তুলনায় তুলনামূলকভাবে শক্ত এবং গোলাকার হয়, যা চায়ের সঙ্গী হিসেবে বেশ উপভোগ্য
বেলা বিস্কুট চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক একটি খাবার। চট্টগ্রামবাসীর কাছে সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ে ডুবিয়ে কিংবা বিকেলের আড্ডায় বেলা বিস্কুটের কোনো বিকল্প নেই। বেলা বিস্কুটের কথা কবি–সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদদের লেখায়ও উঠে এসেছে।
চট্টগ্রামে বেলা বিস্কুট জনপ্রিয় হয়েছে গণি বেকারির হাত ধরেই। ঠিক কখন গণি বেকারিতে বেলা বিস্কুট তৈরি হয় তার সঠিক তথ্য নেই। তবে মোগল আমলের শেষদিকে ও ইংরেজ আমলের শুরুতে ভারতের বর্ধমান থেকে আগত ব্যক্তিরা এই বেকারিশিল্পের সূচনা করেন চট্টগ্রামে। আবদুল গণি সওদাগরের পূর্বপুরুষ লাল খাঁ সুবেদার ও তাঁর ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রির হাত ধরে বেকারি পণ্য তৈরির সূচনা হয় এ অঞ্চলে এমন তথ্যই মিলেছে গবেষকদের লেখায়।
গণি বেকারি নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলা একাডেমির সহ পরিচালক মরহুম আহমদ মমতাজ। তিনি লিখেন– মোগল ও পর্তুগিজদের খাদ্যাভ্যাসে ছিল রুটি, পাউরুটি, বিস্কুটসহ বেকারি পণ্য। তাদের খাদ্যাভ্যাসের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেকারি শিল্পের যাত্রা শুরু হয় প্রায় ২৫০ বছর আগে।
ব্রিটিশ আমলেও তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার মানুষের খাদ্যাভ্যাসের তালিকায় ছিল বেলা বিস্কুট। পান্তাভাতের পরিবর্তে ধোঁয়া ওঠা চায়ে বেলা বিস্কুট ডুবিয়ে সকাল বিকেলের নাশতা সেরে নিতেন তখনকার পৌরসভার মানুষেরা। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামগঞ্জে। আর এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে রপ্তানি হচ্ছে বেলা বিস্কুট।
কথাসাহিত্যিক আবুল ফজলের (১৯০৩–১৯৮৩) কিংবা ইতিহাসবিদ আবদুল করিম (১৯২৮–২০০৭) এর স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বেলা বিস্কুটের জনপ্রিয়তার কথা।
আবুল ফজলের আত্মজীবনী রেখা চিত্রে শৈশব কৈশোর কালের একটি লাইন এ রকম —ঘুম থেকে উঠে পান্তাভাতের বদলে খাচ্ছি গরম–গরম চা বেলা কি কুকিজ নামক বিস্কুট দিয়ে। কুকিজ ইংরেজি নাম বেলা কিন্তু খাস চাটগেঁয়ে।
বেলা বিস্কুটের নামকরণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল ফজল ১৯৬৬ সালে তার আত্মজীবনী রেখাচিত্র গ্রন্থে আরো লিখেছেন, –চন্দনপুরার বেলায়েত আলী বিস্কুটওয়ালার নাম অনুসারে বেলা বিস্কুটের নামকরণ হয়েছে।’ এছাড়া বিভিন্ন গবেষকদের লেখায় ২০০ বছর আগে চট্টগ্রামের বেকারিতে সর্বপ্রথম বেলা বিস্কুট তৈরি হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। আবদুল গণির আগে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেকারি পণ্য তৈরির সূচনা হয় তার পূর্বপুরুষ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার বাসিন্দা লাল খাঁ সুবেদার এবং তার ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রির হাত ধরে। এ হিসাবে দেখা যায় চট্টগ্রামে বেলা বিস্কুটের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের।
দীর্ঘসময় ধরে বেলা বিস্কুটের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। শুধু চট্টগ্রাম নয় দেশের স্বনামধন্য বড় বড় কোম্পানিগুলোও বেলা বিস্কুট তৈরি করছে। বেলা বিস্কুট চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের বিস্কুট। এখন লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা সিডনির মতো শহরে বেলা বিস্কুট পাওয়া যায়।
চট্টগ্রামের বেকারিশিল্পের সব কটিতেই বেলা বিস্কুট তৈরি হলেও এখনো সবাই স্মরণ করেন গণি বেকারির কথা। কারণ গণি বেকারির হাতে ধরেই এই বিস্কুটের প্রথম প্রচলন হয় চট্টগ্রামে।
যুগ যুগ ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহন করা এ ঐতিহ্য প্রসার লাভ করেছে দেশের অন্যান্য স্থানেও। এ অঞ্চলে বিস্কুট তৈরির পদ্ধতি রপ্ত করা হয়েছে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারে পর্তুগিজদের নিয়মিত আগমনের সুবাদে। প্রচলিত রয়েছে পর্তুগিজদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আবদুল গণি সওদাগর প্রথম বেলা বিস্কুটের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন।
বিস্কুট তৈরিতে মাটির তন্দুর এখন বিলুপ্তপ্রায়। সে জায়গা দখল করে নিয়েছে বৈদ্যুতিক ওভেন। আবার ইস্ট ছাড়া বিস্কুট তৈরির কথা ভাবাই যায় না। এসব আধুনিক যন্ত্র আর উপাদান দূরে ঠেলে প্রাচীন বেলা বিস্কুট তৈরি করে যাচ্ছে গণি বেকারি।
আজকের দিনে, বেলা বিস্কুট শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশের ভিতরেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং বিদেশের বিভিন্ন দেশেও এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে চট্টগ্রামের খাবারের ঐতিহ্য কেবল স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাদৃত। একে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, যা চট্টগ্রামের খাদ্য সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।
লেখক: সংস্কৃতিকর্মী, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক