পাহাড়ের জীবন ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি

ফারুক আহমেদ রাজু | মঙ্গলবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

পাহাড়কে আমরা দেখেছি কেবল দূরের আলোকচিত্রে, কী মনোরম দেখলেই মন ভেতরে থেকে বলে উঠে ইশ! এখানে থেকে যেতে পারতাম। ভ্রমণ ব্লগারের অনর্গল বর্ণনায়, কিংবা রঙিন সিনেমার দৃশ্যে, যা অতিশয় অনুকূল। সেখানে পাহাড় মানে যেন নিসর্গের এক রহস্যঘেরা কবিতার পঙ্‌ক্তি মেঘের আস্তরণে ঢাকা সবুজ ঢেউ, পাখির গান, বৃষ্টিভেজা কুয়াশার ধোঁয়াশা আরো রংমশাল আবহ। আমাদের কল্পনায় পাহাড় মানেই কফির ধোঁয়া মাখা বিকেল, জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়া, কিংবা নিস্তব্ধ জুমঘর থেকে চাঁদ দেখার অলৌকিক সৌন্দর্য। আমরা পাহাড়কে এমনভাবে ভাবতে শিখেছি যেন সেখানে মানুষের জীবনের অস্তিত্বই নেই; শুধু প্রকৃতি, শুধু দৃশ্যপট, শুধু রোমান্টিক সৌন্দর্যের অবিনশ্বর ভাণ্ডার। তাই না?

কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই এমন? একটিবার ভেবে দেখুন যে পাহাড় আপনাকে আহ্বান করে নিছক সৌন্দর্যের উল্লাসে, সেই পাহাড়ের বুকেই প্রতিদিন মানুষ লড়ছে কেবল টিকে থাকার জন্য। কতোটা দুর্বিষহ তাঁদের জীবন কখনো ঠাহর করেছেন? আপনি যখন ছুটির দিনে হুট করে পাহাড় দেখতে যান, কেবল দুই রাতের আনন্দে ডুবে যান, তখন পাহাড়ের সেই অচেনা মানুষেরা পিঠে ঝুড়ি বেঁধে পাথুরে পথ পেরিয়ে জ্বালানি কাঠ খুঁজে বেড়াচ্ছে। সেই কাঠ তারা বিক্রি করবে নগন্য দামে, যেন জীবনের ন্যূনতম খরচটা মেটানো যায়। পাহাড়ের দৃশ্য দেখে আপনি বলবেন ‘কী অপূর্ব সৌন্দর্য!’ অথচ ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ একজন হয়তো সুপেয় পানির অভাবে ডায়রিয়ায় প্রাণ হারাচ্ছে। দুর্গম পথ পাড়ি দিতে দিতে অন্তঃসত্ত্বা মা পথেই জীবনের ইতি টেনে নিচ্ছে। কী নিদারুণ নিষ্ঠুর জীবন তাই না?

কোথাও কোনো খবর নেই, কোনো প্রতিবেদনের পাতায় জায়গা হয় না। পাহাড়কে দেখানো হয় কেবল আপনার স্বপ্নের ফ্রেমে, কিন্তু পাহাড়বাসীর যন্ত্রণাকে আড়াল করে রাখা হয় যত্নসহকারে। তাঁরা তো আমার বাংলাদেশের মানুষ, আমাদেরই ভাইবোন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভরে আছে পাহাড়ের ছবিতে সেলফি, ভিডিও, ড্রোন ফুটেজ, কিংবা সাহিত্যের বর্ণনায় মেঘবৃষ্টিকফির অনন্ত উপাখ্যান। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, কোথাও তো বলা হয় না পাহাড়ের এক প্রজন্ম কতটা বঞ্চিত থেকে যায় শিক্ষার আলো থেকে। কখনো কী শুনেছেন পাহাড়ের বুকের ভেতরে কোনো সমৃদ্ধশালী পাঠাগারের কথা? কোনো সংবাদে কি দেখেছেন, পাহাড় থেকে সমতলে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থীদের কতজন আসলে প্রিভিলেজ পরিবার থেকে, আর কতজন একেবারে শূন্যহাতে সংগ্রাম করছে? না, এসব কখনো আপনাকে দেখানো হয় না। কারণ পাহাড়ের মানুষের বাস্তবতা ভেঙে দেয় আপনার কল্পনার স্বর্গরাজ্যকে। তবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অনেক কাজ হচ্ছে প্রশংসার করার পথে, আমি একজন দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে তা কামনা করি আজন্ম।

পর সমাচার; পাহাড়ে যে মানুষগুলো বাস করে, তারা আসলে আপনার কল্পনায় জায়গা করে নিতে পারে না, কারণ তারা সৌন্দর্যের অংশ নয়, তারা কষ্টের প্রতীক। অথচ ঠিক তাদের কাঁধেই পাহাড়ের বাস্তবতা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ঘরে পর্যাপ্ত খাবার নেই, শিশুরা চিকিৎসা পায় না, বয়স্করা কেবল রোগ বয়ে বেড়ায়, অথচ এই সমস্ত সত্য লুকোনো থাকে পর্যটনের বিজ্ঞাপনের আড়ালে। আপনার চোখে যে পাহাড় রহস্যঘেরা পরাবাস্তবতার মতো, সেই পাহাড় আসলে এক অন্ধকার লড়াইয়ের নাম, বঞ্চনার, বেদনার, অশ্রুত মৃত্যুর।

এমনকি পাহাড়ের রাজনৈতিক ইতিহাসও আমাদের সামনে আসে না। যেখানে তারা নিপীড়নের শিকার, হামলার শিকার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকারসেইসব ঘটনার ছায়া আপনার কাছে পৌঁছায় না। ফলে তাঁরাও বিগড়ে যায় লিপ্ত হয়ে যায় প্রতিকূল ধ্বংসাত্মক কোনো কাজে!

সাহিত্য, গণমাধ্যম কিংবা শিক্ষিত সমাজ যেন এক হয়ে পাহাড়কে সাজিয়ে তোলে রোমান্টিসিজমের প্যাকেটে। যেন পাহাড় মানেই কেবল পর্যটকের দৃষ্টিতে সাজানো এক কল্পরাজ্য। সেখানে মানুষের কণ্ঠস্বর নেই, নেই তাদের ইতিহাস, নেই তাদের সংগ্রাম। একটু বের হই তবে, কী বলেন?

কিন্তু সত্য হলো পাহাড়কে যদি সত্যিই ভালোবাসতে চান, তবে তার সৌন্দর্য নয়, তার মানুষের কষ্ট, তার অদৃশ্য ইতিহাস, তার ক্ষুধার্ত শিশু, তার নির্জন পল্লির জীবনযাপন, সবকিছুকেই সমানভাবে দেখতে হবে। অন্যথায় আপনার প্রেম কেবল আত্মপ্রবঞ্চনা, এক ধরনের নিষ্ঠুর ভ্রম। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে কফি হাতে মেঘ দেখা এক ধরনের আনন্দ হতে পারে, কিন্তু তার আড়ালে লুকোনো মানুষের কান্না অগ্রাহ্য করার মধ্য দিয়ে আপনি আসলে পাহাড়কে হত্যা করেন।

তাই বলি পাহাড়ে একদুই দিনের জন্য হুট করে গিয়ে সৌন্দর্য দেখা অবশ্যই সুন্দর, কিন্তু সেটিকে জীবনের সার্বিক সত্যে রূপান্তরিত করবেন না। পাহাড়ের রোমান্টিসিজমকে ভাঙতে হবে, তার অন্তর্গত বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। অন্যথায় পাহাড় শুধু আপনার ছবির অ্যালবামে থাকবে, কিন্তু পাহাড়বাসীর জীবন অন্ধকারেই থেকে যাবে। আর কোনো সাহিত্য, কোনো মাধ্যম, কোনো স্বপ্নই তখন পাহাড়কে মুক্ত করতে পারবে না। আসুন আমরা মানুষ হই, পাহাড় ভালোবাসি, ভালোবাসি পাহাড়ে বসবাসরত আমাদের আপনজনদের।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচাটগাঁর বেলা বিস্কুট
পরবর্তী নিবন্ধআঁরার দুরুস কুরা