ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী, স্কুল-স্বাস্থ্য ও শিশু-বিশ্ব সম্মাননা

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

মানবিক চিকিৎসক হিসেবে প্রণব কুমার চৌধুরীর সুনাম ও খ্যাতি আজ অনেকের মুখে মুখে। লেখায় আর বক্তৃতায় তিনি অসংখ্যবার বলেছেন, ‘আমার মোবাইল নম্বরটি চট্টগ্রামের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর কাছে দিতে চাই। তারা যেন যে কোনো অসুস্থতায় আমার পরামর্শ পায়’। যেখানে অধিকাংশ চিকিৎসক নির্ধারিত সময় ছাড়া রোগীকে সময় দিতে চান না, সেখানে ডা. প্রণব স্বপ্রণোদিত হয়ে এই আহ্বানটি রাখলেন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে। প্রণব কুমার চৌধুরী একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ছাড়াও একজন শিক্ষাবিদ এবং লেখক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। ‘ছোটদের চিকিৎসা সমগ্র’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ছয় খণ্ডের বই। বাংলায় শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত এই প্রকাশনা মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়া তিনি নানা বিষয়ে অসংখ্য বই রচনা করেছেন। বাংলা একাডেমির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও শামসুজ্জামান খান নানা সময়ে প্রণব কুমার চৌধুরীর লেখালেখি বিষয়ে অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন।

প্রণব কুমার চৌধুরীর জন্ম ১৯৬০ সালে। তিনি ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস থেকে পেডিয়াট্রিক্সে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। গ্লাসগোর রয়েল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস থেকে এফআরসিপি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘পেডিয়াট্রিক সায়েন্স’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর পিএইচডির বিষয় ছিল বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলে শিশু এবং শিশুদের ভিটামিন ডি অবস্থা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং প্রধান ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ‘একুশে সাহিত্য পুরস্কার’ ও ‘স্বাধীনতা স্মারক সম্মাননা পদক’ অর্জন করেন। তাঁর অনেক অনন্য কাজের একটি হলো : ‘স্কুলস্বাস্থ্য’ গ্রন্থের প্রকাশ। এ গ্রন্থে যেসব বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে, ‘শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন, শিক্ষাগত অগ্রগতিতে বাধা তৈরি করতে পারে এমন স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি শনাক্তকরণ, শিশুর যে কোনও অস্বাভাবিক স্বাস্থ্য ফলাফলগুলি তাঁর পিতামাতার সাথে যোগাযোগ ও সমাধান, শিশুর শনাক্তকৃত অস্বাভাবিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি কমিউনিটি চিকিৎসকদের কাছে রেফারেল করা, খেলার মাঠের নিরাপত্তা এবং স্কুল শিক্ষার্থীদের যথাযথ শরীরচর্চা নিশ্চিত করা, হতাশা বা অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা আগেভাগে স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা প্রতিরোধের পরিকল্পনা গ্রহণ, তামাক বা ড্রাগ ব্যবহারের ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের শনাক্ত এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং ড্রাগস্‌ আসক্তি রোধে পরামর্শ দান’ প্রভৃতি। এই গ্রন্থকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তার পরিচালিত স্কুলসমূহে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করতে চালু করা হয়েছে ‘স্কুল শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য কার্ড’। এটি রীতিমত অভাবনীয় ও সময়োচিত পদক্ষেপ।

স্কুল শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য কার্ডটিতে শিক্ষার্থীর নাম, জন্ম তারিখ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম, শ্রেণি, পিতামাতার নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বরসহ প্রয়োজনীয় সব পরিচিতিমূলক তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কার্ডে পাঁচ বছর বয়স থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত মোট ১৪ বার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রেকর্ড রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রতিবার স্বাস্থ্য পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর ওজন, উচ্চতা, দাঁতের অবস্থা, চোখ ও কান পরীক্ষার ফলাফল, ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য, রক্তচাপ এবং হিমোগ্লোবিন লেভেল লিপিবদ্ধ করা হবে। কার্ডের একটি পৃথক অংশে রয়েছে টিকাদান রেকর্ড, যাতে জন্মের পর থেকে নিয়মিতভাবে গ্রহণযোগ্য টিকাগুলোর তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন বিসিজি, পোলিও, হেপাটাইটিসবি, এমআর, পেন্টাভ্যালেন্টসহ অন্যান্য অতিরিক্ত টিকা যেমন টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং র‌্যাবিস।

শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর সূত্র মতে, সরকারিবেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি ৭০ লাখ। প্রতিবছরই এ সংখ্যা বাড়ছে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিচর্যার অভাব, চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতার কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এক বিরাট অংশ ব্যাপক অপুষ্টিসহ বিভিন্ন রোগের শিকার। এতে বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার যেমন কমে যায়, তেমনি ব্যাহত হয় তাদের মেধা ও মননের বিকাশ। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব প্রতিফলিত হয় জাতীয় জীবনে। এ বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি নিজে চিকিৎসক বলে তাঁর দায় অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। তিনি বলেন, শিশুদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা শুধু অভিভাবকদের দায়িত্ব নয়, বরং প্রতিষ্ঠান ও সিটি কর্পোরেশনেরও দায়িত্ব। এই উদ্যোগের মাধ্যমে শিশুদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, টিকাদান এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী নিজেই বলেছেন, শিশুবয়সে সুস্বাস্থ্য আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে স্কুলস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে গণ্য করা নিতান্তই জরুরি। স্কুল পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তৈরি হবে দেশের উজ্জ্বল স্বাস্থ্যচিত্র। এ কারণে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে ‘স্কুলস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা’কে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যেভাবে তাদের পরিচালিত স্কুলে ‘স্কুল শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য কার্ড’ চালু করেছে, তেমনি অন্যান্য স্কুলেও এ গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিটা চালু করা প্রয়োজন।

শিশুঅন্তঃপ্রাণ ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী তাঁর সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘শিশুবিশ্ব’ নামক একটি সংস্থা। শিশু স্বাস্থ্য, শিশু শিক্ষা ও শিশুসাহিত্যসংস্কৃতি বিষয়ে এই সংস্থা কাজ করছে চট্টগ্রামে। অতি সম্প্রতি এই সংস্থা থেকে ৩টি সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিশু স্বাস্থ্যসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল প্রফেসর ডা. নুরুন্নাহার ফাতেমা বেগমকে সন্তোষরেণুবালা সম্মাননা, শিশুশিক্ষায় অবদানের জন্য অধ্যাপক আবুল মোমেনকে যোগেন্দ্ররসবালা সম্মাননা ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য যাত্রাশিল্পী মিলন কান্তি দে’কে ভারতননীবালা সম্মাননা প্রদান করা হবে আগামী ২০ সেপ্টেম্বর শনিবার বিকেল ৫টায় চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল প্রফেসর ডা. নুরুন্নাহার ফাতেমা বেগম ইতোপূর্বে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার, আবুল মোমেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক এবং মিলন কান্তি দে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। আমরা এই সুন্দর উদ্যোগের জন্য প্রফেসর ড. প্রণব কুমার চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানাই এবং সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্বদের অভিনন্দন জানাই।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;

ফেলো, বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষাব্রতী আচার্য যোগেশ চন্দ্র সিংহ
পরবর্তী নিবন্ধচবিতে ‘জুলাই বিপ্লবের পূর্বাপর : বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি’ শীর্ষক সেমিনার কাল