শিক্ষাব্রতী আচার্য যোগেশ চন্দ্র সিংহ

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের কুতুবদিয়ার বাতিঘর যেভাবে সমুদ্রকে আলোকিত করে পথহারা জাহাজকে দিক নির্দেশ প্রদান করে। তেমনি যুগে যুগে চট্টগ্রামের আলোকিত ব্যক্তিরা পুরো দেশকে আলোকিত করে জাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে কেউ শিক্ষা প্রসারে, কেউ আধ্যাত্মিক সাধনার এবং ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে। কেউ সমাজসেবায় আবার কেউ বা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন। চট্টগ্রাম তথা বাঁশখালী সেই সব আলোকিত ব্যক্তিদের অন্যতম অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র সিংহ। যোগেশ চন্দ্র সিংহ তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব যিনি সমগ্র চট্টগ্রামকে জ্ঞানের আলোতে উদ্ভাসিত করেছে। চট্টগ্রামের আলোকিত এ মহান শিক্ষাবিদ্‌ আচার্য যোগেশ চন্দ্র সিংহ ১৮৯০ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা প্যারিমোহন সিংহ। গ্রামের পাঠশালায় তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। স্কুলের প্রাথমিক পাঠ শেষ করে ঐতিহ্যবাহী পটিয়া হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১০ সালে পটিয়া হাইস্কুল হতে কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রাস পাশ করেন। কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য যোগেশ চন্দ্র সিংহকে বিশেষ পুরস্কারে ভূর্ষিত করা হয়। পরবর্তীতে তিনি কলিকাতা সিটি কলেজে আই..তে ভর্তি হন। এ কলেজ হতে তিনি কৃতিত্বের সাথে আই.এ পাস করেন। তাঁর ফলাফলের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বঙ্কিমচন্দ্র পদক লাভ করেন। একই কলেজ হতে ইংরেজিতে অনার্স সহ বি.এ পাশ করেন। বি.এ পাশ করার পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এ বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উল্ল্লেখ্য যে যোগেশ চন্দ্র সিংহ বাঁশখালী সহ অত্র এলাকায় প্রথম এম.এ ডিগ্রীধারী ব্যক্তিত্ব।

শিক্ষা জীবন শেষ করে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকতাকে তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। সে সময়ে শিক্ষাকতার পেশাকে সম্মানজনক পেশা হিসেবে গণ্য করা হতো। ১৯১৮ সালে চট্টগ্রাম কলেজে ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর পেশাজীবন শুরু হয়। ১৯১৮ হতে ১৯৪৮ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষকতা করেন। শেষের দিকে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে ইংরেজিতে তাঁর পাণ্ডিত্যে ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু একই সাথে রবীন্দ্র সাহিত্যেও তাঁর সমান দক্ষতা সকলের নিকট ছিল বিস্ময়কর। ইংরেজির অধ্যাপক হয়েও তিনি বাঙালি কবি সাহিত্যিকদের রচনা হতে তুলনামূলক উদ্ধৃতি দিয়ে ছাত্রদেরকে পড়াতেন। ছাত্রদের পাঠদানে তাঁর আন্তরিকতা ও দক্ষতার কারণে তিনি ছাত্রদের নিকট গভীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ছাত্রদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা তাঁকে ছাত্রদের নিকট জনপ্রিয় করে তোলে। ইংরেজি ক্লাসে শেলী, কিটস এর পদ্য পড়াবার সময় তিনি অনর্গল রবীন্দ্রনাথের পদ্য, গান হতে উদ্ধৃতি দিয়ে ছাত্রদের মনের গভীরে প্রবেশ করিয়ে দিতেন।

শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্য জগতেও তাঁর সমান পদচারণা ছিল। ১৯৩৮ সালে কবি বিপিন বিহারী নন্দীর স্বগ্রাম জঙ্গল খাইনে অনুষ্ঠিত কবির স্মৃতি সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে মহীম চন্দ্র দাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কবি নবীনচন্দ্র সেনের স্মৃতি বার্ষিকীতে বক্তৃতা দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি সেন্ট প্ল্যাসিডস স্কুলে অনুষ্ঠিত নজরুল জয়ন্তিতে সভাপতিত্ব করেন। এ সময়ে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘মাতৃ বন্দনা’ ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয়। সে সময়ে স্থানীয় পত্রিকা সমূহে তাঁর লেখা প্রবন্ধাদি নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময়ে তাঁর আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সকলে দেশ ত্যাগ করে ভারত চলে যান। তাঁর মধ্যে দেশপ্রেম এত প্রবল ছিল যে জীবনের শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও সে কঠিন সময়েও তিনি দেশত্যাগ করেন নি। এ বিষয়ে সে সময়ে তাঁর এক সহকর্মী লিখেন, ‘দেশ বিভাগের পর অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করে ভারত চলে যান। কিন্তু তিনি দেশপ্রেমের কারণে জন্মভূমি ত্যাগ করেন নি। ফলে আজীবন তিনি সকল সমপ্রদায়ের নিকট স্মরণধণ্য হয়ে রয়েছেন।’

১৯৪৮ সালে তিনি সরকারি শিক্ষা বিভাগ হতে অবসর নেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কলিকাতা কমার্স কলেজের আসবাবপত্র ও গ্রন্থাদী এনে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে চট্টগ্রাম কলেজের এককালীন সহকর্মী ও নব প্রতিষ্ঠিত কলেজের অধ্যক্ষের অনুরোধে তিনি ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং নব প্রতিষ্ঠিত কলেজটিকে প্রতিষ্ঠা করতে সহযোগিতা করেন। চট্টগ্রামের প্রখ্যাত সমাজকর্মী বাদশা মিয়া চৌধুরী চট্টগ্রামে একটি নৈশ কলেজ প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁর অনুরোধে ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রাম নৈশ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগেশ সিংহ যোগ দেয় এবং সফলতার সাথে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৭ সালে দিবাভাগে একই ভবনে তিনি ভিক্টোরিয়া ইসলামিয়া হোস্টেল ভবনে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন যা পরবর্তীতে নাসিরাবাদ সরকারি মহিলা কলেজে রূপান্তরিত হয়। তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অধ্যক্ষের পদেও দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে অধ্যাপক যোগেশ চন্দ্র সিংহ ১৩২৭ বাংলায় ২৯ বৈশাখ পটিয়ায় স্বনামধন্য উকিল ও হাশিমপুর নিবাসী জমিদার জগৎ চন্দ্র ঘোষের কন্যা স্বর্ণলতা দেবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। একজন সফল শিক্ষক হয়েও শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি লেখালেখির বিষয়ে ছিলেন খুবই সচেতন। জ্ঞানের ঝর্ণাধারা অধ্যাপক যোগেশ চন্দ্র সিংহ একজন সুলেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর প্রণীত সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘ধ্যানী রবীন্দ্রনাথ’ ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থ সমূহ হলো যা প্রকাশকালীন সময় সহ বর্ণনা করা হলো।

প্রকাশিত গ্রন্থ : মাতৃ বন্দনা ১৯৪৪ সাল, মাতৃ প্রশস্থি ১৯৪৪ সাল, পিতৃ তর্পণ ১৯৫৩ সাল, পিতৃ পুজা ১৯৪৭ সাল, আমার ধর্ম (১ম ও ২য় ভাগ) ১৯৪৭ সাল, দুর্গা পূজায় নব পত্রিকা তত্ত্ব ১৯৬৩ সাল, পরমহংস অদ্বেতানন্দ ১৩৭৩ বাংলা, ৮।স্বরস্বতী তত্ত্ব ১৯৬৭ সাল, সীতাবলী ১৯৬৮ সাল, ধ্যানী রবীন্দ্র নাথ ১৯৬৪ সাল, রাস লীলা ১৯৬৪ সাল, গীতা বোধিণী (১ম খণ্ড) ১৩৭২ বাংলা, গীতা বোধিণী (দ্বিতীয় হতে চতুর্থ খণ্ড) ১৯৬৯ সাল (যা শেষ প্রকাশিত হয়)। এছাড়াও তিনি দৈনিক আজাদী, সাপ্তাহিক হিমাদ্রী, দৈনিক ওয়্যাক, দৈনিক স্বাধীনতা, যুগধর্ম প্রভৃতি সংবাদপত্রে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখেছেন। এছাড়াও তাঁর অপ্রকাশিত রচনার পরিমাণ ও কম নয়। জ্ঞানতাপস অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র সিংহ ১৯৭৯ এর ১৫ সেপ্টেম্বর ৮৯ বছর বয়সে চট্টগ্রাম শহরের রহমতগঞ্জস্থ নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশাষ ত্যাগ করেন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী প্রিয় জন্মস্থান বাঁশখালীর সাধনপুরে শেষকৃত্যানুষ্ঠাদি সম্পন্ন হয়। একজন দেশপ্রেমিক ও শিক্ষাবিদ্‌, সমাজ সেবক যোগেশ চন্দ্র সিংহ এর ন্যায় ব্যক্তিত্বদের আমাদের আজ বড় বেশি প্রয়োজন। সূত্র : যোগেশ চন্দ্র সিংহ রচনাবলি ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধসমূহ।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমম্বয়বাদের মূল সুর – ইউসুফ মুহম্মদের দোঁহা
পরবর্তী নিবন্ধডা. প্রণব কুমার চৌধুরী, স্কুল-স্বাস্থ্য ও শিশু-বিশ্ব সম্মাননা