বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে ‘আজাদী’ একটি উজ্জ্বল নাম। দীর্ঘ ৬৬ বছরের পথ চলায় শুধু সংবাদ পরিবেশনই নয় বরং সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রেখে গেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বিশেষ করে চট্টগ্রামের নারী লেখকদের জন্য এটি হয়ে উঠেছে আত্মপ্রকাশের মুক্তমঞ্চ। নারীরা তাদের কলমের শক্তি দিয়ে সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
চট্টগ্রাম সবসময়ই সাহিত্যচর্চার উর্বর ক্ষেত্র। যদিও নারী লেখকদের জন্য লেখালেখির সুযোগ সব সময় ছিল না। সেই জায়গা থেকে আজাদী পত্রিকা নারী লেখকদের জন্য আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এই পত্রিকার সাহিত্য পাতাসহ বিভিন্ন ফিচার পাতায় ও কলামে বহু নারী লেখক তাঁদের লেখা প্রকাশের সুযোগ পেয়েছেন।
চট্টগ্রামে নারী লেখকরা শুধু সাহিত্যিকই নয় তাঁরা পরিবর্তনেরও কণ্ঠস্বর। তাঁদের লেখায় উঠে এসেছে নারী শিক্ষা ও আত্মমর্যাদার প্রশ্ন, সমাজের বৈষম্যের প্রতিবাদ, প্রেম ও মানবতার জয় গান, চট্টগ্রামের প্রকৃতি পাহাড় নদী ও উপকূলের সৌন্দর্য। প্রাতঃস্মরণীয় কয়েকজন নারী সাহিত্যিক পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামে অন্য নারী লেখকদের প্রেরণা উৎস হিসেবে কাজ করেছেন।
উমরতুল ফজল সাহিত্যিক, সাংবাদিক মাহবুব উল আলমের জ্যেষ্ঠ সন্তান। সাহিত্যিক বাবা, চাচা দিদারুল আলম ও কবি ওহীদুল আলমের সান্নিধ্যে থেকে সাহিত্য অনুশীলনে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি সে সময়ের প্রেক্ষাপটে মেয়েদের পক্ষে আশাতীত, উদার মুক্ত অসামপ্রদায়িক একটি বিশিষ্ট পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তিনি আজাদীতে নিয়মিত লিখতেন। এই পত্রিকার আরেক লেখক ফজিলতুল কদর আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক ইসলামি চিন্তাবিদ ও সুলেখক। তাঁর ঝরঝরে লেখনীর মাধ্যমে তিনি ইসলামে নারীর প্রতি উদারতা, নারী সমাজের করণীয় তুলে ধরেছিলেন। চট্টগ্রামের প্রথিতযশা সংবাদিক ফাহমিদা আমিন ছিলেন আজাদীর নিয়মিত লেখক। তাঁর সাহিত্য তৃষ্ণা তাঁকে নিয়ে গেছে এক আলোরস্তম্ভের দিকে। তাঁর সাহসী–কলমে উঠে এসেছে সমাজ, সংস্কৃতি ও নারীর সংগ্রাম। নারী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। তাঁর লেখালেখি নবীন প্রজন্মের নারীদের সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় আসতে উৎসাহিত করেছে।
চট্টগ্রামের গর্ব মুশতারী শফি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও নারী আন্দোলনের কর্মী। তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথায় ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, নারীর মুক্তি এবং মানবতার কণ্ঠস্বর। তিনি শুধু লেখকই নন, ছিলেন সাহসী সংগঠক। জিনাত আজম মূলত শিক্ষা ও সমাজ সেবায় যুক্ত ছিলেন। তবে তাঁর প্রবন্ধ ও নিবন্ধ নারীর শিক্ষা উন্নয়ন ও আত্মমর্যাদাকে তুলে ধরেছেন। রমা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিভিত্তিক, আত্মজীবনীমূলক ‘একাত্তরের জননী’ রচনা করে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন। ড. আনোয়ারা আলম একজন শিক্ষাবিদ। তাঁর লেখায় নারী মুক্তি, সমাজের বিভিন্ন গোঁড়ামি অতিক্রম করে নারীদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা এবং সমাজের বিভিন্ন অসংগতিগুলোকে তুলে ধরেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। আরও অনেক নারী লেখক আছেন যাঁরা বহু গুণে গুণান্বিত। যাঁদের নাম উল্লেখ না করলেই নয়; তাঁরা হলেন বেগম রুনু সিদ্দিকী, রওশন জাহান রহমান, সাহেরা ইসমাইল, মমতাজ সবুর, নীলুফার জহুর, ফেরদৌস আরা আলীম, শামসুন্নাহার রহমান পরান, এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা, ফরিদা ফরহাদ, দীপালী ভট্টাচার্য, ডেইজী মউদুদ, কাজী রুনু বিলকিসসহ আরোও আরও অনেকে যাঁরা প্রতিদিন সাহিত্যকে করছেন সমৃদ্ধ ও প্রাচুর্যময়।
আজাদী পত্রিকার ৬৬ বছরের যাত্রা কেবল একটি পত্রিকার ইতিহাস নয়, এটি চট্টগ্রামের সংস্কৃতির গৌরবগাথা। এই গৌরবময় যাত্রায় নারী লেখকদের অবদান অনস্বীকার্য।